|
|
|
|
|
|
|
অন্যদের জন্য শহিদ হোয়ো না |
একটা সহজ কথা অন্যের প্রতি অন্যায় না করার মতোই নিজের প্রতি অন্যায় না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
এত পড়াশোনা করার পর যদি কেউ তোমায় নিজের পছন্দমত কাজ করতে না দেয়, সেটা কিন্তু তোমার
প্রতি অন্যায়। সেটা মেনে নেওয়া অনুচিত। বলছেন রংগন চক্রবর্তী |
|
আমার বয়স কুড়ি বছর। ২০১১ সালে হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে সেরা ছাত্র হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছি। ক্যাম্পাসিং-এর সময় একটা ভাল হাসপাতালে চাকরি পাই, কিন্তু শিফটিং ডিউটির জন্য মাস দুয়েক পর চাকরি ছাড়তে হয়। আমার পরিবার থেকে বেসরকারি চাকরি করতে দিলেও তারা চায় শুধু ডে শিফট-এর চাকরি। এখন আমার বিয়ের জন্য বাবা মা চেষ্টা করছে। বেশির ভাগ পাত্রপক্ষের আমায় পছন্দ হলেও ‘গণ-রাশি’ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে। তাদের মতে আমি নাকি রাক্ষস গণ, এই জন্য বিয়েগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের পরিবার এ সব কিছু মানে না। কিন্তু এর ফলে আমার বাবা মা বেশ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন। বাবা-মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। আমিও অবসাদে ভুগছি। আমি কী করে এর থেকে মুক্তি পাব এবং বাবা মাকেও বোঝাতে পারব? দয়া করে পরামর্শ দিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
|
তোমাকে বলছি |
দেখো, আমাদের জীবনে নানান রকমের সমস্যা আসবেই। সাহস করে আমাদের সেগুলোর সঙ্গে লড়ে যেতে হবে। তাই বলছি, ভেঙে পোড়ো না। এই যে তুমি উদ্যোগ নিয়ে আমাদের একটা ই-মেল পাঠিয়েছ, এতেই তো বোঝা যাচ্ছে যে তুমি উদ্যম হারাওনি। তোমার চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে যে তুমি চাকরি করতে চাও। বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই, সম্বন্ধ করে বিয়েতেও আপত্তি নেই। কিন্তু নিরর্থক সংস্কারের মধ্যে পড়তে তোমার আপত্তি। আজকের দিনে এই সব গণ, রাশি বিচারের মধ্যে আটকে থাকাটা সত্যিই দুঃখের। কিন্তু চার পাশে এই সব ব্যাপার কমছে না। ফলে এই সব নিয়ে তো আমাদের মাথা ঘামাতেই হবে।
তুমি কী চাও সেটা যদি আমরা ঠিক করে ফেলি, তা হলে আমরা বোধ হয় দেখব যে বিয়ের পরেও তুমি চাকরি করতে চাও। তুমি একটা যোগ্যতা তৈরি করেছ। দেখাই যাচ্ছে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতেই তুমি একটা ভাল চাকরি পেয়েছিলে। কাজেই সেই কাজের জায়গা, সেই যোগ্যতার জায়গা তোমার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেবল মেয়ে বলে সেটা তোমাকে বিসর্জন দিতে হবে কেন?
তোমাকে আসলে একটা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে হবে যাতে তুমি তোমার লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারো। এ কথা ঠিক যে এখনও অনেক পরিবার কুষ্ঠি বিচারে আটকে আছে। অনেক ছেলে বা তাদের পরিবার চান না তাদের বাড়ির বউ বিয়ের পর চাকরি করুক। আবার দেখবে এমন পরিবার আছে যারা চাকরি করা বউ চায়। কারণ অনেক ছেলে চায় যে স্ত্রী একটা কাজের জীবনে থাক। দু’জনে চাকরি করলে যে সব দিক থেকেই সুবিধেজনক, সেটা অনেক পরিবারই বোঝে। কাজেই দ্যাখো এমন সব পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগের দিকে এগোনো যায় কি না। বাবা-মাকে বলো এই ধরনের ছেলে পেতে হলে চাকুরিরতা পাত্রী বলতে পারলে সুবিধে, আর তার জন্যেই বিয়ের আগে তোমার একটা চাকরি দরকার। এটাও বলো যে এখন তোমাকে হয়তো শিফট ডিউটির চাকরি নিতে হতে পারে কারণ এই মুহূর্তে তুমি নানান রকম শর্ত দেওয়ার জায়গায় নেই। কিন্তু চাকরিটা পেয়ে গেলে, তার পর বিয়ে হয়ে গেলে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি সেই চাকরিতেই শিফট নিয়ে নানান নেগোসিয়েশনে যেতে পারো। তা না হলে একটা চাকরির ওপর দাঁড়িয়ে আর একটা চাকরি খুঁজতে পারবে। এগুলো সব সময়েই বেশি সুবিধেজনক।
একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে। তুমি কাউকে কষ্ট দিতে চাও না। কিন্তু অন্যদের জন্যে শহিদ হয়ো না। তাতে কারও কোনও লাভ হবে না। এই যে তুমি পড়াশোনায় ভাল হয়েও, প্রথম হয়েও, কেবল মেয়ে বলে চাকরি করতে পারবে না, নিজের পরিবারের বাইরে কাজের জগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, এই বিচারটা অন্যায়। সেই বিচার যদি প্রিয়জনেরাও করেন, তাঁরা অন্যায় করছেন। আমি এ কথা মনে করি না যে বাবা মা যা বলেন সব ভুল, বা অল্প বয়সে আমরা যা মনে করি সব ঠিক। কিন্তু তুমি তো খুব ঠান্ডা মাথায় খুব কমই চাইছ। তুমি কেবল চাইছ নিজের কাজের জায়গা আর একটা সংসার যেখানে ‘তুমি রাক্ষসী’ বলে সারা ক্ষণ কথা শুনতে হবে না। নিজের এই চাওয়াটুকুকে অন্যায় বলে ভেবে কষ্ট পেও না। এটা কিন্তু আমাদের সমাজের একটা কায়দা, তারা মেয়েদের খুব স্বাভাবিক চাওয়াকেও অন্যায় বলে অপরাধবোধে ভোগানোর চেষ্টা করে। এই কায়দাটাকে চিনতে শেখাটাও খুব জরুরি। কেন একটি ছেলে নাইট ডিউটি করতে পারবে, একটি মেয়ে পারবে না?
যে সমাজে একটি মেয়ে নাইট শিফটে চাকরি করতে যেতে ভয় পায়, সে সমাজে ‘রাক্ষস গণ’ আসলে কারা বলো তো? |
|
বাবা-মাকে বলছি |
মেয়েকে নিয়ে আপনাদের গর্বিত হওয়া উচিত। একটি পেশাদারি ক্ষেত্রে ও ক্লাসে সফল হয়ে ক্যাম্পাসিং-এই চাকরি পেয়েছিল। মেয়েরা যদি পড়াশোনা করে সেই শিক্ষা কাজের জগতে প্রয়োগ করতে না পারে, তবে তাদের জীবন খুবই কষ্টকর হয়ে ওঠে। আপনারা বলতে পারেন, আপনি তো বলেই খালাস। একটি মেয়ের শিফট ডিউটি কি নিরাপদ? কিংবা তার শ্বশুরবাড়ি কি তার নাইট ডিউটি মেনে নেবে? কথাটা হল যদি নিরাপদ না হয়, তা সত্ত্বেও মেয়েকে আটকে রাখাটা তার সমাধান নয়। আজকে যে তুলনামূলক ভাবে সংখ্যায় কম হলেও মেয়েরা নাইট ডিউটিতে যাচ্ছে, নানান ধরনের চাকরিতে যাচ্ছে, তার একমাত্র কারণ কিন্তু এই যে অনেক মেয়েরা সাহস করে এই চাকরিগুলো করা শুরু করেছিল। তারাই এই নতুন সাহসের জায়গাটা তৈরি করছে। আপনাদের মেয়ের বয়স মাত্র কুড়ি। ওকে চাকরি করতে দিন। যদি ও এবং আপনারা চান যে ওর বিয়ে হোক, তবে এমন ছেলে ও শ্বশুরবাড়ির খোঁজ করুন যাঁরা ওর স্বাধীনতাটাকে সম্মান করবে। মেয়ের ভাল চেয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করে দেবেন না।
মেয়েটার দিকে এক বার ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, একটা মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে চাইছে। এই ইচ্ছেটাকে সম্মান করাই আমাদের কাজ হওয়া উচিত। |
|
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।
ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।
অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১ |
|
|
|
|
|
|