রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
ড্রয়িংরুমে এলসিডি টিভির সামনে বসে হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেন তিনি। মাঝারি মাপের হলঘরে যে গোটা কমিউনিটির লোক উঠে এসেছে, সে দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। ষাটোর্ধ্ব ছোটখাটো চেহারার শ্যামশঙ্কর তিওয়ারি কোনও মতে বলে চলেছেন, “হামার বিটুয়া করকে দিখাইলেবা। আমার ছেলে করে দেখাল। আমার টিম করে দেখাল।”
বছর তিরিশের যুবক রাজকুমার তিওয়ারিকেও আটকানো যাচ্ছে কোথায়? টপটপ করে জল পড়ছে চোখ থেকে। কান্নার নয়, আনন্দের। বলছিলেন, “জানতাম, জিতবে জানতাম। দিনভর প্রার্থনা চলেছে ভাই আর ওর টিমের জন্য। এত কিছু কখনও ব্যর্থ হতে পারে?”
এঁদের পরিচয়? পদবি থেকেই আন্দাজ করে নেওয়া যায়। কেকেআরকে প্রথম আইপিএল ট্রফি এনে দেওয়া মনোজ তিওয়ারির এঁরা পরিবারবর্গ। প্রথম ভদ্রলোক বাবা। দ্বিতীয় জন দাদা। এবং প্রশ্ন উঠতে পারে, এঁরা কী করেননি কেকেআর এবং মনোজের জন্য।
রাত পৌনে আটটা। টিভিতে তখন আদরের ‘মন্নি’-র মুখ। কেকেআর জার্সিতে জাতীয় সঙ্গীতে ডুবে। মা বীনা তিওয়ারি অহরহ কপালে হাত ঠেকিয়ে ঈশ্বরকে ডাকছেন। আচমকা ড্রয়িংরুমের অন্য দিক থেকে ডাক, “আপনারা এ বার একে একে চলে আসুন।”
|
নাইটদের সাফল্য কামনায় যজ্ঞ করছেন মনোজের মা
বীণা ও বাবা শ্যামশঙ্কর তিওয়ারি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
মোটেই একসঙ্গে বসে ম্যাচ দেখার আমন্ত্রণ নয়। ওখানে যজ্ঞের আয়োজন। এবং বিশালকায়। ঘি, কাঠ সহ নানাবিধ উপকরণের দেদার ব্যবস্থা। গনগনে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ার চোটে চোখ খুলে রাখাই দায়। গায়ে নামাবলি চাপানো পুরোহিতের ডাকে সেখানে বসে পড়লেন মনোজের বাবা-মা। ব্যাপার কী? কী আবার, ছেলের ব্যাটে রান চাই। কেকেআরকেও জেতাতে হবে। অতএব যজ্ঞ, এবং পুরোহিত তখনই দিব্যি বলে যাচ্ছেন, “এর নাম রুদ্রচণ্ডী যজ্ঞ। দুপুর একটা থেকে চলছে। এ জিনিস কখনও ব্যর্থ হয় না।”
কে জানত, রাত বারোটায় তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে? মাঝরাতে বাংলা অধিনায়কের পাড়াতে আপাতত শুধু একটাই শব্দ। বাজির। মিষ্টিমুখ চলছে দেদার। আলোচনা চলছে, নায়ক ফিরলে কী ভাবে দেওয়া হবে তাঁকে সংবর্ধনা। মনোজের পরিবারের তরফ থেকে ঘোষণা: সোমবার আশপাশের হাজারখানেক গরীব-দুঃখীর জন্য থাকবে ‘দাওয়াত’। মনোজ ফিরলে কেক কাটা হবে। পাড়ার একদল পা বাড়িয়েই আছেন সোমবার এয়ারপোর্ট থেকে মনোজকে নিয়ে আসার জন্য।
এয়ারপোর্ট থেকে আনা হবে আরও এক জনকে। তবে একটু অন্য ভাবে। লক্ষ্মীরতন শুক্লর পরিবার জানিয়ে দিচ্ছে, টিম বাস বা গাড়ি নয়। ঘোড়ার গাড়ি করে আনা হবে লক্ষ্মীকে!
মনোজের পাড়ায় শুধু বাজি হলে ঘুসুড়িতে রাতে নেমে পড়েছে আবার ব্যান্ডপার্টি। পাড়ার লোকদের ম্যাচ দেখতে সুবিধা হবে বলে, জায়েন্ট স্ক্রিন বসিয়ে দিয়েছিল শুক্ল-পরিবার। মনোজের জোড়া বাউন্ডারিতে ম্যাচ পকেটে আসার পর সেখানে উদ্দাম নাচ, সঙ্গে কুর্নিশ। লক্ষ্মীর বাবা উমেশ শুক্ল তো বলেই দিলেন, “এর নাম টিম স্পিরিট। সেমিফাইনালে লক্ষ্মী দুর্দান্ত খেলল। ফাইনালটা জেতাল মনোজ। কুর্নিশ ওকে জানাতেই হবে।” কোথাও ছেলের মঙ্গলকামনায় যজ্ঞের আয়োজন। কোথাও ‘নায়ক’-কে টাঙায় চাপিয়ে বাড়ি ফেরানোর প্রস্তুতি। হাউই, পটকা সব মিলিয়ে কলকাতার এই ভূখণ্ড যেন ‘সব পেয়েছির দেশে’। বাংলার জন্য বাঙালি গলা ফাটাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ‘অন্য ভুবন’-ও তো রয়ে গেল এই শহরে। যেখানে শোক আছে, উৎসব নেই। আঁধার আছে, আলো নেই।
ঠিকানা সল্টলেকের নয়াপট্টি। কেকেআরের জয়ের পর যেখানে ফোন করা হলে কেউ ধরলেন না। সন্ধের ছবিটাকে বরং তুলে দেওয়া যাক। সোফায় বসে ভদ্রলোক। বলছেন, “কী করব? ছেলে যে দিকে, সে দিকেই তো সমর্থন থাকবে।” রাতে কথাগুলোকে হাহাকার মনে হতে পারে। ইনি, প্রশান্ত সাহা। পরিচয়, তিনি ঋদ্ধিমান সাহার বাবা।
ফোন ধরার উপায় কী? ছেলে যে আজ ছিল চেন্নাইয়ের জার্সিতে!
|
কার হাতে কী |
চ্যাম্পিয়ন: কলকাতা নাইট রাইডার্স
রানার্স: চেন্নাই সুপার কিংস
টুর্নামেন্টের সেরা প্লেয়ার: সুনীল নারিন
সেরা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স: এবি ডেভিলিয়ার্স
সর্বোচ্চ রান: ক্রিস গেইল (৭৭৩)
সর্বোচ্চ উইকেট: মর্নি মর্কেল (২৫)
সেরা ক্যাচ: ডেভিড হাসি
সেরা ভারতীয় উঠতি তারকা: মনদীপ সিংহ |
|