মিশরে বহু-প্রতীক্ষিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল। হোসনি মুবারকের বিদায়ের ১৫ মাস পর এই নির্বাচন। ইতিমধ্যে সে দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচিত হইয়াছে এবং তাহাতে মুসলিম ব্রাদারহুড ও রাজনৈতিক ইসলামের প্রবক্তারা গরিষ্ঠতা পাইয়াছেন। কিন্তু এই পার্লামেন্টের হাতে দেশের সামরিক পরিষদ শাসনক্ষমতা ছাড়ে নাই। রাজধানী কায়রো শহরের তাহরির স্কোয়ারে যে স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষোভে বিস্ফোরিত হইয়াছিল, তাহার লক্ষ্যই ছিল গণতন্ত্রের, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের প্রতিষ্ঠা। তাহার প্রথম ধাপ পার্লামেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়া সাঙ্গ হইলেও জনপ্রতিনিধিরা এখনও ক্ষমতা বুঝিয়া পান নাই। তাই এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এত সুদূরপ্রসারী। প্রথম দফার ভোটে কেহই গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দুই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাদারহুডের মহম্মদ মুর্সি এবং মুবারকপন্থী আহমদ শফিকের মধ্যে জুনের মাঝামাঝি দ্বিতীয় দফার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইবে। এই নির্বাচনের ফলাফলই স্থির করিয়া দিবে, আগামী দিনে মিশর তথা সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের চেহারা কী রূপ পরিগ্রহ করিবে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া সমগ্র মিশর জুড়িয়া জনসাধারণের মধ্যে যে ব্যাপক উদ্দীপনা লক্ষ করা গিয়াছে, তাহাতেই মনে হয়, এমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বোধহয় সেই দেশে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত হয় নাই। মিশরীয়দের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তাঁহাদের আফ্রিকান ও আরব প্রতিবেশীদের ছাপাইয়া গিয়াছে। বিশেষত মুসলিম মহিলাদের বিপুল অংশগ্রহণ পর্যবেক্ষকদের রীতিমত অবাক করিয়াছে। মুসলিম ব্রাদারহুড গোটা আরব দুনিয়াতেই রাজনৈতিক ইসলামের মুখ্য প্রবক্তা। মিশরবাসীকে সক্রিয় ভাবে ভোটগ্রহণে অংশ লইতে তাহারাই প্ররোচিত করিয়াছে। পূর্বের তুলনায় অনেক নরমপন্থী ও গণতান্ত্রিক এই দলের প্রধান লড়াই এখন উদারনৈতিক শাসনপ্রণালী বা রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের সহিত নয়, বরং উগ্র ইসলামের প্রবক্তা সালাফিদের সহিত, যাহারা সৌদি অর্থ ও মতাদর্শে পুষ্ট। অন্য দিকে মুবারক জমানার শেষ প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক আইন-শৃঙ্খলা ও সুস্থিতি ফিরাইবার দাবি তুলিয়াছেন। মনে হইতে পারে, তিনি তহরির স্কোয়ারের অভ্যুত্থানকে নাকচ করিতে উদ্যত, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে নিজের তেমন ভাবমূর্তি শফিক চাহিবেন কি না, তাহা সংশয়ের বিষয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইলেই অবশ্য মিশরের সমস্যা মিটিবে না। সামরিক পরিষদ ক্ষমতা হস্তান্তর না করিলে প্রেসিডেন্ট কার্যত কাঠের পুতুল। বিগত পনেরো মাস ধরিয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করিবার পরে জেনারেলরা দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া পড়িবেন না, কে বলিতে পারে? তা ছাড়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও নূতন শাসন ব্যবস্থায় সামরিক পরিষদের ভূমিকা কী হইবে, কোথায় টানা হইবে তাহার ক্ষমতা ও এক্তিয়ারের সীমানা, তাহার গণতান্ত্রিক মীমাংসা হওয়া দরকার। যাহা উদ্বেগের বিষয়, তাহা হইল, এখনও নূতন বন্দোবস্তের রূপরেখা নির্ণায়ক সংবিধান অ-রচিত। তাহা রচনার ভার যদি প্রেসিডেন্ট কিংবা সামরিক পরিষদের উপর ন্যস্ত হয়, তবে তাহাতে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হইবে কি না, সন্দেহ। নির্বাচিত পার্লামেন্টকেই সংবিধানসভার মর্যাদা দিয়া নূতন শাসনপ্রণালী নির্ণয় করিবার দরকার ছিল। |