বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে এ বার দলের জাতীয় রাজনীতির এক প্রধান চরিত্র রূপে উঠিয়া আসিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে তিনি যে প্রধানমন্ত্রী পদের এক অন্যতম দাবিদার হইবেন, তাহার ইঙ্গিত স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদীকে লক্ষ করিয়া সমবেত জনতার উচ্ছ্বাস তাঁহার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করিয়াছে। বিজেপির অপর কোনও মুখ্যমন্ত্রীর সহিত তাঁহাকে যে এক আসনে রাখা সঙ্গত নহে, কর্মসমিতির বৈঠকে এবং শুক্রবারের জনসভায় তাহা প্রমাণ করিয়াছেন নরেন্দ্র মোদী। তবে তাঁহার রাজনৈতিক উত্থান সহজ হইবে না। দলের শীর্ষ দুই নেতা, লালকৃষ্ণ আডবাণী ও সুষমা স্বরাজ মুম্বইয়ে কর্মসমিতির বৈঠক শেষেই বিদায় লইয়াছেন, জনসভায় তাঁহাদের দেখা যায় নাই। কিন্তু বিজেপির অপর কোনও মুখ্যমন্ত্রী কর্মসমিতির বৈঠক কিংবা প্রকাশ্য জনসভার মঞ্চ বয়কট করেন নাই। এমনকী ‘বিদ্রোহী’ বলিয়া পরিচিত কর্নাটকের বি এস ইয়েদুরাপ্পাও ‘সুবোধ বালক’ হইয়া উপস্থিত ছিলেন। এই মুহূর্তে বিজেপি দলে স্বতঃসিদ্ধ নেতা বলিয়া কেহ নাই -- দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পান নাই। নেতৃত্বের একটি প্রধান শর্ত জনসমর্থন, সেই নিরিখে নরেন্দ্র মোদীর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের উপরেও তাই তিনি চাপ সৃষ্টি করিতেছেন। বিজেপিতে তাঁহার স্থান এখন ঠিক কোথায়, তাহা স্পষ্ট। এই স্থানটি মোদী নিজ চেষ্টায় অর্জন করিয়াছেন।
মোদী যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অপশাসনের তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন, তাহাতে ইঙ্গিত মিলিল যে তিনি বিপক্ষের দুর্বলতা এবং নিজের শক্তি বিষয়ে সচেতন। মোদী যে সফল প্রশাসক, তাহা অবিসংবাদিত। তাঁহার নেতৃত্বে গুজরাতের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটিয়াছে, তাহা নজিরবিহীন। দুর্নীতির কোনও বড় অভিযোগও তাঁহার সরকারের বিরুদ্ধে নাই। প্রশাসনিক দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে দলীয় কর্মকর্তাদের স্বজনপোষণের চিরাচরিত প্রথাও তিনি অগ্রাহ্য করিয়াছেন। মোদীর কর্মসংস্কৃতি গুজরাতবাসীর হৃদয় জয় করিয়াছে, উপর্যুপরি নির্বাচনেই তাহা প্রমাণিত। ইউপিএ-র দুর্বল, দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসন জনতার নিকট মোদীকে গ্রহণযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। ইহা এক বিরল সুযোগ। কিন্তু সংকটও কম নহে। মোদীর ভাবমূর্তিতে ২০০২ সালের গোধ্রা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে, সহসা তাহার অপনোদন হওয়া কঠিন। এখনও সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁহার মনোভাব ও আচরণে সেই নিরপেক্ষতা নাই, অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁহাকে রাজধর্ম পালন করিতে বলিয়া যাহার ইঙ্গিত দিয়াছিলেন। আদালতে তাঁহার সরকারের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি একে-একে অপ্রমাণিত হইলে কী হইবে, সংখ্যালঘুদের প্রতি বিমাতৃসুলভ পক্ষপাতের অভিযোগ হইতে মোদীর সরকার মুক্ত নয়। সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সম্ভাবনা মোদীর ক্ষেত্রে অধরাই থাকিয়া যাইবে, যদি বিজেপির সহযোগী এনডিএ শরিক দলগুলি, এবং বৃহত্তর জনতা তাঁহার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। স্মরণ থাকিতে পারে, বিজেপিকে প্রায় একক প্রয়াসে কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করিয়াও লালকৃষ্ণ আডবাণীকে কেবল ‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’ হইবার দায়ে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি একদা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ছাড়িয়া দিতে হইয়াছিল। মোদী যে এখনও বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো হিন্দি বলয়ের হৃদয়পুরে দলের জন্য নির্বাচনী প্রচারে আমন্ত্রিত হন না, বরং তাঁহাকে প্রচারসূচি হইতে নির্বাসিত রাখা হয়, ইহা তাঁহার সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতার অভাবেরই প্রমাণ। মোদী তাঁহার অগ্রগতির পথে ইহাদের কত জনকে শামিল করিতে পারিবেন, এখন তাহাই দেখিবার বিষয়। |