কোনও জিনিস খুব সস্তা হলে আমরা বলি, ‘জলের দাম’। খুব দামি হলে এ বার থেকে হয়তো বলতে শোনা যাবে ‘তেলের দাম’। বাজার এখন নড়াচড়া করছে এই তেলের দামকে কেন্দ্র করেই। পেট্রোলের দাম এক লাফে ৭.৫০ টাকা বাড়ায় সবাই অখুশি হলেও শেয়ার বাজার কিন্তু স্বাগত জানিয়েছে এই বৃদ্ধিকে। কয়েক দিন ধরে নামতে থাকা সেনসেক্স তেলের দাম বাড়ার খবরে লাফিয়ে বাড়ে ২৭৪ অঙ্ক। আবার উঠে আসে ১৬ হাজারের ঘরে। বিদেশে তেলের দাম বাড়লে বাজার পড়ে, কমে টাকার দাম। দেশে তেলের দাম বাড়লে কিন্তু ফল হয় উল্টো। বাজার এখন বসে আছে ডিজেলের দাম বাড়ার অপেক্ষায়। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে মূল্য নির্ধারণে তেল বিপণন সংস্থাগুলির স্বাধীনতা প্রকাশ পায়। কমে ভর্তুকি। বাণিজ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস খুশি করে শেয়ার বাজারকে। বাজার সব সময়েই ভর্তুকি রাজের বিরুদ্ধে।
পেট্রোলের দাম বাড়ায় কিছুটা শক্তি ফিরে পায় তেল সংস্থার শেয়ার। নিম্নগতি পায় মারুতি, টাটা মোটরস ইত্যাদি গাড়ি সংস্থার শেয়ার। পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করবে স্কুটার ও মোটরবাইক সংস্থাকেও। ব্যাঙ্ক শেয়ার কিছুটা বেড়েছে এই আশায় যে, আগামী দিনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ কমাতে পারে।
গত সপ্তাহে কয়েকটি নামী কোম্পানির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য এফএমসিজি কোম্পানির মতো নজর-কাড়া ফলাফল প্রকাশ করেছে আইটিসি। বছরের শেষ তিন মাসে কোম্পানির নিট লাভ প্রায় ২৬% বেড়ে পৌঁছেছে ১৬১৪ কোটি টাকায়। গোটা বছরে কোম্পানির একত্রিত লাভ প্রায় ২৫% বেড়ে পৌঁছেছে ৬২৫৮ কোটি টাকায়। প্রতিটি ১ টাকা মূল্যের শেয়ারে কোম্পানি এ বার ডিভিডেন্ড দেবে ৪.৫ টাকা। অন্য যে-সব এফএমসিজি কোম্পানি এই দুর্বল বাজারেও শেয়ারের দাম ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে হিন্দুস্তান ইউনিলিভার, কোলগেট, এশিয়ান পেন্টস, ম্যারিকো, নেসলে, গ্ল্যাক্সো, পিঅ্যান্ডজি, গোদরেজ কনজিউমার ইত্যাদি। চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস-এর নিট মুনাফা ২১% বেড়ে পৌঁছেছে ৩৩৮০ কোটি টাকায়। ২০১১-’১২ সালের জন্য কোম্পানি শেয়ার পিছু চূড়ান্ত ডিভিডেন্ড দেবে ৩.৬৮ টাকা। শেষ তিন মাসে টাটা গ্লোবালের নিট লাভ ৩৬% কমলেও গোটা বছরে আগের বছরের ২৫৪ কোটি টাকার জায়গায় লাভ হয়েছে ৩৫৬ কোটি টাকা। ২০১১-’১২ সালে কানাড়া ব্যাঙ্কের লাভ কমেছে ১৭%।
বাজার এবং দেশের কাছে এখন বড় সমস্যা হল ডলারের চড়া দাম। এর ফলে আমদানির খরচ বেড়েই চলেছে। অন্য দিকে বিশ্ব বাজারে মন্দা চলায় রফতানি তেমন বাড়ছে না। আসছে না বিদেশি লগ্নিও। দেশে পেট্রোলের দাম এমন সময় বাড়াতে হল, যখন বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমছে। এই মূল্যবৃদ্ধি মূলত টাকার তুলনায় ডলারের চড়া দামের জন্য। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আদৌ সুখকর নয়। সমস্যা-জর্জরিত সরকারও দিশা দেখাতে পারছে না। তেল সিংহভাগ ডলার, শুষে নিলেও তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই কথা বলছে না। অনিশ্চিত বাজারে সোনাই এখন নিশ্চিন্ত লগ্নির জায়গা। ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, ঋণ-নির্ভর ফান্ডও ভাল লগ্নি টানছে। যাঁরা ‘ঝুঁকিতে সুখী’, তাঁরা এখন কমা জলে বেছে বেছে ভাল মাছ ধরার সুযোগ পেয়ে কম দামে তুলে নিচ্ছেন ভাল শেয়ার।
নতুন ইস্যুর বাজার এখন এক রকম প্রাণহীন। বাজারে একনাগাড়ে মন্দা চলায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বেচে টাকা তোলার রাস্তায় নামতে পারছে না সরকার। বাজার এই ভাবে দমে থাকলে নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনাও কমবে। কারণ শুধু ঋণের উপর ভিত্তি করে কোনও বড় প্রকল্প দাঁড়াতে পারে না। খরচের অন্তত ২৫% আসা উচিত ইক্যুইটির মাধ্যমে। ঋণে সুদও যথেষ্ট চড়া। শিল্প স্থাপনে মন্থরতা এলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। চাহিদা কমবে মূলধনী পণ্যের। এই পরিস্থিতিতে প্রায় নিষ্প্রাণ মিউচুয়াল ফান্ড শিল্প এবং ব্রোকারেজ সংস্থাগুলিও। ফলে কর্মসংস্থান কমছে এ সব ক্ষেত্রেও। বাজার দেশের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কবে আবার প্রাণ ফিরবে, তা জোর দিয়ে কেউই বলতে পারছেন না। |