গণতন্ত্রের অভাব থাকলেও তেল-গ্যাসের অভাব নেই লৌহ যবনিকার আবডালে থাকা প্রতিবেশী দেশটিতে। অগোচরে সেই প্রাকৃতিক সম্পদে ভাগ বসাতে এগিয়ে এসেছে চিন। নিরাপত্তার দিক দিয়েও এই মায়ানমার গুরুত্বর্পূণ। কেন না, উত্তর-পূর্বের বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি রয়েছে সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ি জঙ্গলে। এই পরিস্থিতিতে ২৫ বছর পরে সৌহার্দের বার্তা নিয়ে সেই মায়ানমারে পা রাখলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
এই নয় মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের এই প্রথম যোগসূত্র রচনা হবে মনমোহনের এই সফরে। বস্তুত বছর সাতেক ধরেই সে দেশে নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে দিল্লি। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, গণতন্ত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সে’টি তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। মায়ানমারের সেনাশাসকদের দূরে সরিয়ে রাখলে তারাও ভারতের স্বার্থের বিষয়গুলিতে চোখ বুজে থাকবে। আর সেই সুযোগে প্রভাব বাড়াবে প্রতিদ্বন্দ্বী চিন। ভারতের কৌশল কিছুটা হলেও কাজ দিয়েছে। আবার মায়ানমারের সেনাশাসকরাও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্রের ‘পরিবর্তনের পথে’ এগোনোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমেরিকাও দূরে সরিয়ে রাখার নীতিতে বদল এনে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে মায়ানমারের সঙ্গে।
‘পরিবর্তনকামী’ মায়ানমারের সঙ্গে নিজেদের ‘অভিজ্ঞতা’ ভাগ করে নেওয়ার বার্তা নিয়েই আজ সে দেশে পৌঁছলেন মনমোহন। নয়াদিল্লি থেকে রওনা হওয়ার আগে তিনি জানিয়েছেন, “মায়ানমার গণতান্ত্রিক শাসনের পথে এগিয়ে চলেছে। বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছে ভারত। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত।” বিদেশ মন্ত্রক জানাচ্ছে, এই সফরের তাৎপর্য গভীর। মনমোহন সরকারের ‘পূবে তাকাও’ নীতির সফল রূপায়নের জন্য নেপিদও-এর সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি নয়াদিল্লির কাছে। মায়ানমারকে ব্যবহার করে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যসেতু গড়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত, তা তখনই সফল হবে যখন মায়ানমার সরকারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস পাওয়া যাবে। চলতি সফরে সেই আশ্বাস সংগ্রহ করাটাই সব চেয়ে বড় অভীষ্ট ভারতীয় কূটনীতিকদের। |
শক্তি ক্ষেত্র থেকে কৃষিপণ্য সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারত যে বিনিয়োগ এবং রফতানির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করতে চায়, সেই ইঙ্গিত আজ দিয়েছেন মনমোহন সিংহ। পাশাপাশি ভারত-মায়ানমারের সীমান্তে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গি দমন তথা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও সমান গুরুত্ব পেতে চলেছে আগামী তিন দিনের শীর্ষ বৈঠকগুলিতে। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়ানো, দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলি আমার সফরে অগ্রাধিকার পাবে।” বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও সই হবে তাঁর সফরে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ইয়াঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাল গবেষণা সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ভারতীয় বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই আগেই জানিয়েছিলেন, সীমান্ত যাতে নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ থাকে তা নিশ্চিত করা দু’দেশের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। পাশাপাশি সীমান্তে ‘ছোট মাপের উন্নয়ন প্রকল্প’ গড়ার ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীর চলতি সফরে ভারতের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হবে। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, এই বিষয়টি ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। এর আগে নেপাল সীমান্তেও এই মডেল অনুসরণ করে ফল পেয়েছে ভারত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, আলফা (পরেশ), এনএসসিএন (কে), অথবা মনিপুরের ইউএনএলএফ-এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সশস্ত্র ক্যাডাররা এখনও মায়ানমার সীমান্তে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে। প্রশাসনের তরফে তাদের সহায়তা করা না হলেও স্থানীয় মানুষের কাছে তারা আশ্রয় পাচ্ছে। সেখানকার মানুষের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারলে, এই ঘাঁটিগুলিকে ভেঙে দেওয়া যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। |