দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তি কেন দেশবাসীকে আদৌ বিন্দুমাত্র উদ্দীপিত করিল না, তাহা বুঝিতে অসুবিধা নাই। উদ্দীপিত হওয়া দূরস্থান, আশায় বুক বাঁধিবার মতো কোনও রূপালি রেখাও এই সঘন মেঘচ্ছায়ে আবৃত জাতির আকাশে নজরে পড়িল না। তাই রাজধানী দিল্লিতে চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধী, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং সরকার ও প্রধান শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে বর্ষপূর্তির উদ্যাপন উপলক্ষে একটি নৈশভোজের আয়োজন থাকিলেও তাহা জাতিকে প্রাণিত করে নাই। বরং অরুণ জেটলিকে বিদ্রুপ করিতে শুনা গিয়াছে: বিপর্যয়ের আবার বার্ষিকী উদ্যাপন? বাস্তবিকই দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের তিন বছর পূর্তিতে সরকারের বলিবার মতো কোনও অর্জন নাই। অর্থনীতির অবস্থা করুণ। আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি হইবে, ইহা খুব বড় আশাবাদীও ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছেন না। ডলারের বিনিময়ে টাকার মূল্য অবনমনের নিম্নগামী নাগরদোলায় সওয়ার। তেলের দাম লহিয়া রাজনৈতিক ছেলেখেলা চলিতেছে। শেয়ার বাজার নিম্নগামী। শিল্পোৎপাদনের হারও তাহাই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত। উপরন্তু একের পর এক আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সরকার কাঠগড়ায়। কমনওয়েল্থ কেলেঙ্কারি, টু-জি কেলেঙ্কারি, বেআইনি খনি কেলেঙ্কারিপ্রতিটিতেই ইউপিএ মন্ত্রীদের অনিয়মের কারণে দেশ বহু কোটি টাকার রাজস্ব হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। আর, সর্বোপরি রহিয়াছে সরকারের প্রশাসনিক নিশ্চেষ্টতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা। একের পর এক জরুরি বিল অধিবেশনের পর অধিবেশনে সংসদে পড়িয়া থাকিতেছে, ‘সংসদীয় কমিটির পর্যালোচনা’র হিমঘরে প্রেরিত হইতেছে। পেনশন বিল, খুচরো বিপণনে বিদেশি লগ্নি সংক্রান্ত বিল, বিমানবন্দর আধুনিকীকরণে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি বিষয়ক বিল, শ্রম-সংস্কার বিল, জমি-অধিগ্রহণ বিলের সংশোধনী ইত্যাদি হরেক বিল অনির্দিষ্ট কাল ঝুলিয়া থাকায় কার্যত শাসনকার্যেই এক ধরনের জড়ত্ব ও বন্ধ্যা নিষ্ক্রিয়তা জাঁকিয়া বসিয়াছে। এখন আবার সরকারি উচ্চ পদে দুর্নীতির উপর নজরদারি চালানোর ‘জনলোকপাল বিল’-এর খসড়াও হিমঘরে প্রেরিত হইল। সংসদের অধিবেশনগুলি ঠিকমতো পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও শাসক দলের অকর্মণ্যতা ও অনীহা স্পষ্ট। উদারনৈতিক সংস্কারের গতি তো রুদ্ধই, নীতিবিষয়ক সিদ্ধান্তগ্রহণেও সরকারকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বলিয়া মনে হইতেছে। দেশীয় শিল্পপতিরা হতাশ। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বহুজাতিক লগ্নি সংস্থাগুলিও পক্ষাঘাতগ্রস্ত সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা দেখিয়া মুখ ঘুরাইয়া লইতেছেন।
যে জনাদেশ লইয়া ইউ পি এ দ্বিতীয় দফায় শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিল, তাহার প্রতি সরকার কোনও সুবিচারই করিতে পারেন নাই। এখন অশীতিপর মনমোহন সিংহ যে ভাবে কোনও ক্রমে ইউপিএ-র তরণীটি বাহিয়া চলিয়াছেন, তাহাতে মনে হইতেছে, তিনি ক্লান্ত, বাণপ্রস্থগমনে উদ্গ্রীব। যেন কোনও মতে আর একটা লোকসভা নির্বাচনের গন্তব্য অবধি ইউপিএ-কে পৌঁছাইয়া দিতে পারিলেই তাঁহার দায় শেষ। অথচ, কংগ্রেসের পরবর্তী প্রজন্মও নেতৃত্ব সামলাইবার মতো সাবালকত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা হইতে এখনও অনেক দূরে। শরিক দলগুলির সহিত কংগ্রেসের সম্পর্কও এমন তলানিতে ঠেকিয়াছে যে, সংসদে জরুরি বিল পাশ করানো কিংবা আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরকার পক্ষের প্রার্থীকে জিতাইয়া আনা লইয়াও সংশয় প্রবল। স্বভাবতই জনসাধারণের ইউপিএ-র কাছে আর বিশেষ প্রত্যাশা নাই। ইহা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের দায়ই সর্বাধিক। |