বাম-জমানায় পুরুলিয়ায় শুরু হওয়া শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ‘থমকে’ যাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকেই দায়ী করল সিটু। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বও স্পষ্ট করে দিলেন, শিল্পায়নের প্রশ্নে রাজ্য সরকারের ‘ভ্রান্ত’ জমি নীতির ‘শিকার’ হিসাবেই দেখা হচ্ছে পুরুলিয়াকে। এই জমি নীতির সমালোচনাকে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করতে চান তাঁরা।
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে একাধিক বেসরকারি ও সরকারি শিল্প-প্রকল্প জমি-জটে থমকে আছে। সেই রঘুনাথপুরেই সিটুর জেলা সম্মেলন (৮ম) উপলক্ষে রবিবার সমাবেশে সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “দ্বিতীয় দুর্গাপুর হতে পারত রঘুনাথপুর। তৃণমূলের সরকার সেই সম্ভবনা নষ্ট করে এলাকাকে পিছিয়ে দিয়েছে।” যদিও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “শিল্প গড়তে রাজ্য সরকার বদ্ধ পরিকর। জমি জটিলতায় কোনও শিল্প থমকে যাবে না।”
সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, নতুন সরকারের ‘ভ্রান্ত’ জমি নীতিই এর মূল কারণ। যে নীতির সার কথা, বেসরকারি শিল্পসংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না রাজ্য সরকার। সংস্থাকে সরাসরি জমি কিনতে হবে।
এই নীতির জন্যই বর্ধমানের কাটোয়ায় এনটিপিসি-র প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই ছবি রঘুনাথপুরে। পুরুলিয়া জেলা সিটুর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যে শিল্পগুলি গড়ে ওঠার বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল, তা এই সরকারের নেতিবাচক ভূমিকায় হচ্ছে না। অথচ, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনায় যখন রাজ্যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তখনও শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে।’
ঘটনা হল, বাম-আমলেই পুরুলিয়ার এই অঞ্চলে একাধিক শিল্প-প্রকল্প গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পূর্বতন সরকার সেখানে তিন হাজার একরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু নতুন সরকার এখানে শিল্পের জন্য এক ছটাক জমিও নেয়নি। সেই সূত্র ধরেই পঞ্চায়েত ভোটের আগে নিতান্ত জেলাভিত্তিক প্রচারে সীমাবদ্ধ না রেখে বিষয়টিকে ‘ব্যাপকার্থে’ তুলে ধরতে চান সিপিএম নেতৃত্ব। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার কথায়, “আমরা অবশ্যই তৃণমূল সরকারের ভ্রান্ত জমি নীতির বিষয়টি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচারে আনব।” তাঁর দাবি, “শিল্পায়ন হলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার সার্বিক উন্নতি হবে, এই আশাতেই মানুষ জমি দেন সরকারকে! সেই আশা কোথায় পূরণ হল? সিঙ্গুর থেকে রঘুনাথপুরসর্বত্র সরকারের প্রতি জমিদাতাদের মোহভঙ্গ হচ্ছে। এটাই আমরা প্রচারে বোঝাব।”
রঘুনাথপুরে ডিভিসি কয়েক হাজার কোটি টাকার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ছে। কাজ প্রায় শেষের মুখে। কিন্তু কয়লা ও জল আসবে কোন পথে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রেলপথ এবং ‘ওয়াটার করিডর’ গড়ার জমি পাচ্ছেন না ডিভিসি। জমির সমস্যায় ভুগছে বেসরকারি জয় বালাজি গোষ্ঠী, শ্যাম স্টিল ও আধুনিক গোষ্ঠীও। রঘুনাথপুর ১ ব্লকে ইস্পাত, সিমেন্ট ও তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার কথা জয় বালাজির। অন্য দুই সংস্থাও ইস্পাত প্রকল্প গড়বে। বাস্তব বলছে, প্রয়োজনীয় ৩,৬০০ একর জমির মধ্যে এখনও পর্যন্ত রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম জয় বালাজিকে দিয়েছে ১,০৯৪ একর। আধুনিকের চাহিদা প্রায় ২,৩০০ একর। পেয়েছে ৫০৫ একর। আর শ্যাম স্টিল ১,১০০ একরের মধ্যে পেয়েছে ৬০০ একর। অধিগৃহীত জমিতে কারখানা গড়ার কাজ শুরু না হওয়ায় এলাকায় ক্ষোভও ছড়াচ্ছে।
রাজ্য সরকারের সঙ্গে ‘লিজ চুক্তি’ হওয়ার তিন বছরের মধ্যে ওই তিন সংস্থাকে প্রকল্প গড়তে হবে বলে সম্প্রতি পুরুলিয়ায় এসে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সিপিএম নেতৃত্বের প্রশ্ন, বাকি জমি ওই সংস্থাগুলিকে দেবে কে? জমির মালিকদের সঙ্গে জমির দাম বা অন্য সমস্যা নিয়ে শিল্পসংস্থার ‘বিবাদ’ বাধলে, তা-ই বা কে মেটাবে?
রঘুনাথপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ রায়ের মতে, “শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কাল্পনিক কিছু নয়। জমির সমস্যা মেটাতে প্রশাসন বা স্থানীয় বিধায়ককে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তৃণমূলের কেউ সে চেষ্টা করছেন না! ওদের জমি নীতি শেষ সম্ভাবনাতেও পেরেক পুঁতেছে!”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “শিল্পে কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে, বিধানসভায় প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। সবাই বুঝছেন, কী রাজত্ব চলছে, কেউ আসতে চাইছে না।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি ও মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর অবশ্য দাবি, “শিল্পায়ন ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া। তা রঘুনাথপুরেও চলছে। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সংস্থাগুলিকে বলেছেন, প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে। রঘুনাথপুরে শিল্পায়নই আমাদের মূল লক্ষ্য।” |