কলকাতার হাসপাতালে নার্সের চাকরি করাটা খুব সহজ ছিল না ওঁদের পক্ষে। মাতৃভাষা মালয়ালম। রোগীদের কখন কী দরকার ঠিকঠাক বুঝতে সমস্যা হত। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কাছেও হামেশাই জুটত বকুনি। ঢাকুরিয়ায় আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে অশক্ত রোগীদের বাঁচাতে কিন্তু মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন ওই দুই সেবিকা। বিনীতা পি কে এবং রেমিয়া রাজারাপ্পন। বিষাক্ত ধোঁয়ার গ্রাস থেকে বেশ কয়েক জন রোগীকে বাঁচিয়েও নিজেরা বাঁচতে পারেননি। মৃত্যুর ছ’মাস বাদে আত্মদানের স্বীকৃতি হিসেবে দুই কেরল-কন্যাকে এ বার রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হল।
বয়স বড়জোর ২১-২২ বছর। গত ৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকুরিয়া আমরির অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে ৯৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ওই দুই তরুণীই শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের ‘ব্যতিক্রমী মুখ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। দেশে এই প্রথম মৃত্যুর পরে কাউকে জাতীয় ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল পুরস্কারে ভূষিত করা হল। শনিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বিনীতার বাবা ও রেমিয়ার মা।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদের কথায়া, “নার্সদের এই সম্মান নিঃস্বার্থ সেবা ও বিরল দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি।” অর্থমূল্য ৫০ হাজার টাকা। শনিবার রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এই সম্মানের পদক ও শংসাপত্র নিলেন দেশের ৩৪ জন সেবিকা। আর ‘নিলেন’ জীবন দিয়ে বিরল দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়া দু’টি সাহসী মেয়ের বাবা ও মা। |
গত ৮ ডিসেম্বর রাতে বিষাক্ত ধোঁয়া হাসপাতালের ভিতরে ছড়িয়ে পড়লেও অশক্ত রোগীদের উদ্ধারে কার্যত হুঁশ ফেরেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আমরির অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের ভিতরে জানলার কাচ ভেঙে কিছু স্থানীয় যুবকের সাহায্যে তিন বা চার তলা থেকে নেমে বাঁচার চেষ্টা করেন কয়েক জন রোগী। হাসপাতালের উঁচু তলার কর্তাদের অনেককেই তখন ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। বিনীতা ও রেমিয়ার মতো গুটিকয়েক নার্সই তখন রোগীদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
বিনীতা-রেমিয়ার সহকর্মীরা জানিয়েছিলেন, অন্তত ৮ জন রোগীকে অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের জানলা দিয়ে বার করতে সাহায্য করেন বিনীতা। কিন্তু নিজে আর মুক্ত বাতাস অবধি পৌঁছতে পারেননি।
পরে হাসপাতালের ওই ভবনের মধ্যে থেকে অন্য রোগীদের সঙ্গে বিনীতা ও রেমিয়ার নিথর দেহও উদ্ধার করা হয়।
আমরি-কাণ্ডে চরম গাফিলতির অভিযোগে হাসপাতালের ১২ জন ডিরেক্টর-সহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করেছে কলকাতা পুলিশ। হাসপাতালের ন’জন ডিরেক্টর ও তিন জন আধিকারিককে কয়েক মাস হাজতবাসও করতে হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা হলেও অন্য রকম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন বিনীতা ও রেমিয়া।
আগুনের ঘটনার মাস চারেক আগে কলকাতায় চাকরি করতে এসেছিলেন দু’জনেই। দু’জনেই গরিব ঘরের মেয়ে। দ্বাদশ শ্রেণি পাশ। বাংলা-ইংরেজি বা হিন্দিতে ততটা সড়গড় নন। তাই খানিকটা চুপচাপ থাকতেন তাঁরা। আমরির কর্মীরা জানালেন, বিনীতা ছিলেন, কিছুটা ভীতু ধরনের। ডিউটির সময়ে সারা ক্ষণ শশব্যস্ত হয়ে থাকতেন তিনি। আমরির এক প্রাক্তন কর্মীর কথায়, “দু’টি মেয়েই কখনও কাজে ফাঁকি দিত না। তবে টুকটাক ভুলের জন্য মাঝেমধ্যেই বকুনি খেত। মৃত্যুর পরে ওদের কাজটা তা-ও স্বীকৃতি পেল!”
আর দেশ পেল প্রথম দু’জন মরণোত্তর ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গলকে! |