রোহিতের জাদুতে আইপিএলে ভেসে উঠলেন সচিনরা
ডেন থেকে শুধু সংবর্ধনা, রাজভোগ, আবেগ, ভালবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে গেলেন না সচিন তেন্ডুলকর। নিয়ে গেলেন মহামূল্যবান ২ পয়েন্ট। যা তাঁর মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে মেঘে ঢাকা আকাশের মধ্য থেকে বের করে উঠিয়ে দিল আইপিএল পয়েন্ট টেবিলের তিন নম্বরে। ১৩ ম্যাচ থেকে সচিনদের এখন ১৬ পয়েন্ট। নাইটদের সমসংখ্যক ম্যাচ থেকে পয়েন্ট ১ বেশি। ১৭। সহবাগের দিল্লি ডেয়ারডেভিলস এখনও টেবিলের শীর্ষে।
আইপিএলের নতুন ফর্ম্যাটে লিগ পর্বের এক এবং দুই নম্বর হিসেবে শেষ করা টিম হওয়া মানে ফাইনাল খেলার ব্যাপারে লটারি পেয়ে গেলে। এক এবং দুই নম্বর টিম প্রথম কোয়ালিফায়ার্স খেলবে। সেখানে জয়ী টিম সোজাসুজি চলে যাবে ফাইনালে। হারা টিম আর একটা সুযোগ পাবে ফাইনালের টিকিট জোগাড় করার। তৃতীয় এবং চতুর্থ দলের মধ্যে জয়ীদের সঙ্গে তাদের খেলা হবে। সেই ম্যাচ যারা জিতবে তারাই হবে দ্বিতীয় ফাইনালিস্ট। এ বারের আইপিএল যে পাঁচ বছরের ইতিহাসে সবথেকে নাটকীয় আইপিএল তা ইডেন ম্যাচের পর আবার প্রমাণিত। কয়েক ঘণ্টা আগে যাদের শেষ চারে যাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল সেই মুম্বই এখন শুধু শেষ চারের দৌড়ে ঢুকে পড়ল না, টেবিলের প্রথম দুই দলের মধ্যে শেষ করার সম্ভাবনাও আচমকা ভেসে উঠেছে তাদের সামনে।
সাত ম্যাচ পরে হারের ধাক্কা
হতাশার কারণ রোহিত শর্মা সেরার
পুরস্কার নিয়ে। ছবি : শঙ্কর নাগ দাস
ইডেনে হতাশ শাহরুখ।
ছবি : উৎপল সরকার
এ দিনের ম্যাচটা মুম্বই কত মরিয়া ভাবে জিততে চেয়েছিল, দু’টো ছবি থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল। এক) যখন জাক কালিসের মারা ছয় গিয়ে পড়ল ক্লাব হাউসের পাশের ছাদে আর বলটা ওখানেই আটকে রইল। আম্পায়াররা নতুন বল নামানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন এমন অবস্থায় দেখা গেল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ডাগআউট থেকে ছুটতে ছুটতে আসছেন তাদের এক সাপোর্ট স্টাফ। সটান রেলিং বেয়ে তিনি উঠে গেলেন বলটা পেড়ে আনতে। নতুন বল মানে সেটা অনেক বেশি শক্ত থাকবে। ব্যাটসম্যানদের স্ট্রোক নিতে সুবিধে হবে। সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। শাহরুখ খান ঠিক সামনের বক্সে। ‘রা ওয়ান’-এর সুপারহিরো যেন চোখের সামনে দেখলেন ‘স্পাইডারম্যান’ উঠে যাচ্ছে। প্রবীণ দর্শকদের কেউ আশেপাশে থাকলে তাঁর হয়তো মনে পড়ে গেল কনরাড হান্টের স্মৃতি। সাতষট্টির জানুয়ারিতে অগ্নিগর্ভ ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় পতাকা আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে আটকাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ট্যান্ড বেয়ে উপরে উঠে পতাকা নামিয়ে এনেছিলেন হান্ট।
দুই) যখন ম্যাচ জিতে ওঠা সচিন তেন্ডুলকর শিশুর মতো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন অধিনায়ক হরভজন সিংহকে। বরাবর ইডেন খুব পয়মন্ত মাঠ ভাজ্জির। শনিবারও টিমের কঠিন সময়ের মধ্যে শূন্য হাতে ফেরাল না। ক্যাপ্টেন্সিটাও করলেন দারুণ। মালিঙ্গাকে শুরুতে মাত্র এক ওভার দিলেন। তার পর আবার ফিরিয়ে আনলেন ১৪ নম্বর ওভারে। নাইটদের তখন ওভার প্রতি ১১-১২ করে চাই এবং ম্যাচের ওটাই মোক্ষম সময়। সেই ওভারটায় মালিঙ্গা দিলেন ৭। ব্যস, ওখান থেকে মুম্বই একদম বোতলবন্দি করে ফেলল নাইট রাইডার্স ব্যাটিংকে। তার পর ম্যাচ শেষের ওই ছবি। এমনকী ডাগ-আউট থেকে প্রত্যেককে খুঁজে খুঁজে বের করে আনলেন সচিন। যাঁরা খেলেননি, বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁদেরও। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ইডেনে জিতে দলগত সংহতির একটা নতুন বলয়ই যেন তৈরি করে দিতে চান তিনি চলো, এখান থেকে আমরা সবাই আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি মুম্বইয়ের অধরা আইপিএল জেতার জন্য!
আগের শনিবার ইডেনে ছিল দাদা বনাম কলকাতা। এই শনিবার সচিন বনাম কলকাতা। অবিকল সেই ‘বঙ্গভঙ্গ’-র আবহ। মুম্বই ড্রেসিংরুম থেকে সচিন তেন্ডুলকর বের হতেই জনতা এমন গর্জন করে উঠল যে, গুলিয়ে যাবে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ইডেনে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলছে, না ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে! সচিনকে নিয়ে রাজ্য সরকার আর সিএবি-র সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দেখে ইডেনের ডেসিবেল আরও বেড়ে গেল। আবার যেই সচিন ২ রানে স্টাম্পড্ হলেন, জায়ান্ট স্ক্রিনে রায় ঘোষণা হল যে, তিনি ‘আউট’, ইডেন তাদের নতুন নেওয়া নীতিতে ফিরল। প্রিয় চ্যাম্পিয়নকে সম্মান দিতে কার্পণ্য করব না, কিন্তু সেটা কখনও হোম টিমের স্বার্থক্ষুণ্ণ করে নয়। আগের দিন ‘দাদা’-কে আবেগভরা সমর্থন জানিয়েও ইডেন কেকেআর-কেকেআর করে সারাক্ষণ চেঁচিয়েছে। সচিনের বেলাতেও ব্যতিক্রম ঘটল না।
আবার আগের শনিবার ছিল দাদা এবং খান। এই শনিবার দিদি এবং সচিন। একটু আগে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন যে ইডেনকে দেখে গুলিয়ে যাচ্ছিল সচিন ঘরের মাঠে খেলছেন না বাইরে, তা-ই মুহূর্তে ভোল পালটে ফেলল সচিন আউট হওয়ায়। না হলে তিনি আউট হয়ে বাইশ গজ থেকে প্যাভিলিয়নে ফেরার রাস্তা ধরেছেন আর সারা স্টেডিয়াম আনন্দ করছে এমন অভিজ্ঞতা ইডেনে কি আর কখনও প্রত্যক্ষ করেছেন সচিন তেন্ডুলকর?
অথচ দর্শকদের জন্য আজ সেরা ‘ডুয়েল’-এর মশলা মজুত ছিল। সচিন বনাম লি। অস্ট্রেলিয়ায় সেই বিতর্কিত রান আউটের ঘটনার পর আজই তো প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাত ছিল। আর সেই দ্বৈরথটাই কিনা হল না! তার আগেই আউট হয়ে গেলেন। ম্যাচ শেষে দু’জনের হাসতে হাসতে হাত মেলানো দেখে অবশ্য মনে হল, অস্ট্রেলিয়ার তিক্ততা এখন অতীত।
এটাই বা কে ভেবেছিল, শনিবারের ইডেনে সচিন শুধু আবেগের ছবি হয়ে থাকবেন। ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যের সেরা ছবি হয়ে থাকবেন তাঁর অনুজ রোহিত শর্মা। তাঁর চলনে-বলনে সারাক্ষণ কেমন একটা ঘুমন্ত ভাব। কথাও বলেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। কিন্তু বাইশ গজে ব্যাট হাতে দাঁড়ালে রোহিত যেন সনাতন দিন্দা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের তুলির টানে মাতিয়ে দেবেন। ইডেনের এ রকম কঠিন পিচ। গেইলদের বিরুদ্ধে গম্ভীরের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে কেকেআরের ১৯০ বাদ দিলে এখানে গড়পড়তা টিম স্কোর হচ্ছে ১৪০-১৫০। এই পিচে সেঞ্চুরি করার কথা লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের জন্যও ভাবতেন কিনা সন্দেহ। সেই পিচে ১৮০ স্ট্রাইক রেট রেখে ৬০ বলে অপরাজিত ১০৯ মানে অলৌকিক ব্যাটিং! দুর্দান্ত সব স্ট্রোক নিলেন। ক্রিকেটীয় সব শট। লি-কেও হুক করে উড়িয়ে দিলেন মিডউইকেটের ওপর দিয়ে। রজত ভাটিয়ার একটা ওভারে নিলেন ১৯। ইনিংসে ১২টা চার, ৫টা ছয়। একমাত্র সমীহ আদায় করলেন সেই সুনীল নারিন। চার ওভারে দিলেন ২৮। প্রতিপক্ষ ১৮২ তুলেছে এমন দিনেও দশটা ডট বল করলেন। মালিঙ্গা ছাড়া এত প্রভাবসম্পন্ন বোলার আর আইপিএলে দেখা যায়নি। তফাত হচ্ছে, মালিঙ্গা শুধু কৃপণ বোলিংই করেন না। উইকেট তুলেও ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেন।
এর আগে ছ’টা ম্যাচ টানা জিতেছে কেকেআর। ইডেনে ডেকান চার্জার্সের সঙ্গে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া ম্যাচ ধরলে সাত ম্যাচ অপরাজিত। সেই সোনার দৌড় আজ থেমে গেল। কিন্তু সোনার দৌড় যখন চলছিল, তখনও নাইটদের অভ্যন্তরে কেউ কেউ আতঙ্কিত ছিলেন ব্যাটিং নিয়ে। ভয় পাচ্ছিলেন, বড্ড বেশি গম্ভীর-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে ব্যাটিং। যে দিন অধিনায়ক ব্যর্থ হবে, সে দিন না টিম ধসে পড়ে। শনিবারের ইডেন দেখিয়ে দিল, আশঙ্কাটা একেবারে অমূলক নয়। দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ স্ট্রাইক রেট। কালিস ভাল খেললেও স্ট্রাইক রেট ১০৫-এর ওপরে যাচ্ছে না। মনোজ তিওয়ারির ব্যাটে সেই ফুলকিটা অনুপস্থিত। বোঝাই যাচ্ছে ভারতীয় দলের বাইরে বসে থাকতে থাকতে তাঁর ফর্ম আক্রান্ত হয়েছে। ইউসুফ পাঠান কোনও প্রভাব ফেলতে পারছেন না। নাইটদের অন্দরমহলে কারও কারও যে মনে হচ্ছে ঠিক সময়ে শনিবারের ইডেন ম্যাচ একটা ‘ওয়েক-আপ কল’ দিয়ে গেল, হয়তো ঠিকই মনে হচ্ছে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.