একশো বছর আগের এক টুকরো ইতিহাস ‘পরিচিতি’ পেল শংকরের হাত ধরে!
দিন কয়েক আগে এডিনবরার এক পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালায় জুতোর বাক্সের ভিতর থেকে মিলেছিল পুরনো কলকাতার বেশ কিছু ছবি। তার মধ্যেই ছিল একশো বছর আগের রাতের কলকাতার একটি ছবি। যাতে দেখা যাচ্ছে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়িঘর। সংগ্রহশালার তরফে জানানো হয়েছে, শংকরের উপন্যাস ‘চৌরঙ্গি’-র ইংরেজি অনুবাদ থেকেই ওই ছবির জায়গাটি শনাক্ত করতে পেরেছেন সংগ্রহশালার বিশেষজ্ঞরা।
ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহ কয়েক আগে। পুরনো ‘গ্লাস প্লেট নেগেটিভ’-এর তাকগুলো পরিষ্কার করছিলেন এডিনবরার রয়্যাল কমিশন অফ দ্য অ্যানশিয়েন্ট অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল মনুমেন্টস অফ স্কটল্যান্ড’ (আরসিএএমএইচ)-এর সংগ্রহ বিভাগের প্রধান লেসলি ফার্গুসন। হঠাৎই তাকের এক কোণে চোখে পড়ল জিনিসটা। ধূসর রঙের ন’নম্বর ‘পিটার লর্ড’ চটির বাক্স!
বাক্স খুলে ফার্গুসনের চক্ষু চড়কগাছ! ভিতরের জিনিসগুলো তো পুরাতাত্ত্বিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত যে কারও কাছে অমূল্য সম্পদ! ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকা দিয়ে মোড়া ১৭৮টি কাচের টুকরো। প্রতিটি টুকরোয় বন্দি রয়েছে ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ উপনিবেশের কিছু মুহূর্ত। নেগেটিভের আকারে। পাঁচ ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি বাক্সে পোরা এক একটা টুকরো আক্ষরিক অর্থেই দুর্মূল্য! |
নেগেটিভ দেখে ফার্গুসন প্রাথমিক ভাবে বুঝলেন ছবিগুলি ভারতের। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো নিয়ে ছুটলেন স্থাপত্য-ঐতিহাসিক ক্লেয়ার সোরেনসেনের কাছে। কলকাতার ‘স্কটিশ সিমেট্রি’ পর্যবেক্ষণে ২০০৮-এ শহরে এসেছিলেন ক্লেয়ার। অভিজ্ঞ চোখ দেখামাত্র রায় দিল, ছবিগুলি কলকাতার। কিন্তু সেগুলির সঙ্গে এমন কোনও বর্ণনা ছিল না, যা থেকে সময় সম্পর্কে কোনও ধারণা পাওয়া যায়। কাচের নেগেটিভ থেকে ছবি স্ক্যান করে সূত্র হাতড়াচ্ছিলেন ক্লেয়ার। ছবিতে মিলল না কিছুই। মিলল নেগেটিভের মোড়কে। যে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ দিয়ে জড়ানো ছিল ছবিগুলো তার সালটা ১৯১৪।
দু’য়ে দু’য়ে চার করলেন ক্লেয়ার! তাঁর কথায়, “১৯১১-১২ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ এবং রানি মেরির ভারতযাত্রার কথা জানতাম। সে উপলক্ষে কলকাতার সব বাড়ি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। নেগেটিভগুলোয় রাতের কলকাতার একটা আলোকিত ছবি ছিল। সেটা দেখেই বুঝলাম ছবিটা ওই সময়ের।” কিন্তু জায়গাটা কোথায়? এখানেই শংকরের উপন্যাসের সাহায্য নিয়েছেন ক্লেয়ার। শংকরের ‘চৌরঙ্গি’ উপন্যাস পড়েই ক্লেয়ার বুঝতে পারেন ওই ছবিতে যে আলোকিত বাড়িটা দেখা যাচ্ছে যেটা ৪ নম্বর এসপ্ল্যানেড ইস্টে এইচ হবস অ্যাং কোং-এর দোকান। শংকরের ‘চৌরঙ্গি’তে উল্লেখ রয়েছে হ্যারি হবসের। পরে হ্যারি হবসের জীবনী পড়ে ক্লেয়ার এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হন। ‘চৌরঙ্গি’ প্রসঙ্গে তাঁর আরও বক্তব্য, “নিউ বেঙ্গল ক্লাবের আলোকিত ছবিটাও শনাক্ত করেছিলাম ওই বইয়ের ছবি দেখেই।”
শংকরের উপন্যাস ছাড়াও নেগেটিভের অন্যান্য ছবি শনাক্ত করতে ভারত ঘোরার অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন বন্ধুদেরও সাহায্য নিয়েছেন ক্লেয়ার। কথা বলেছেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বরুণ দে-র সঙ্গেও। ওই বাক্সবন্দি সম্পদ কী ভাবে ওই সংগ্রহশালায় পৌঁছল, তা নিয়ে অবশ্য এখনও ধন্দে তিনি। সংগ্রহশালার পুরনো নথি ঘেঁটে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
তবে, ক্লেয়ারের অনুমান, ছবিগুলো কোনও স্কটিশ নাগরিকের তোলা। কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, “প্রথমত, কিছু স্কটিশ মালপত্রের সঙ্গেই ওই নেগেটিভগুলো পাওয়া যায়। তা ছাড়া, অধ্যাপক দে বলেছিলেন, ছবি দেখে মনে হয়, চিত্রগ্রাহক বাংলা বলতে পারতেন। ওই সময় বেশ কিছু স্কটিশ নাগরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষাবিস্তারে যুক্ত ছিলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের বাংলা জানাটা অসম্ভব নয়।” একশো বছর আগের ইতিহাসকে এমন সযত্নে রক্ষা করার জন্য ন’নম্বর জুতো ব্যবহার করা সেই ‘রহস্যময়’ স্কটিশ নাগরিকের তারিফ না করে পারছেন না ক্লেয়ার! |