জব্বর মেলা বসেছে রাইগ্রামে। বিমান মেলা।
বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই। ঠা ঠা রোদ্দুর। তাতে কী! আশাপাশের গাঁ উজার করে, শেষ দুপুর থেকে বিকেল, মানুষের ঢল নেমেছে রাইগ্রামের মাঠে। ধুলোয় ছেয়ে আছে মাঠ। তার মধ্যেই পড়ন্ত বিকেলে হলুদ-সবুজ বিমান-দর্শন। গাঁয়ের মানুষকে কী ধুলোয় দমানো যায়! কোথায় চললে? গুলহাটিয়া, সালিন্দা, মালিহাটির মেয়ে-বউ থেকে ছেলে-বুড়ো, উত্তর একটাই, ‘ওই বিমান মেলায় গো!’
আশপাশের গ্রামের বউ-ঝিয়েরা এখন দ্রুত সেরে রাখছেন রান্না, মাঠের কাজও দ্রুত গুটিয়ে জোয়ান-মুনিষ খাটা মানুষ চলল মেলায়। সস্তার খেলনা, ঝালমুড়ি, ফুচকা, আট-আনার আইসক্রিম, ‘লবেঞ্জুস’ আর ছেলেছেকরার হাতের মোবাইল। থেকে থেকেই যা ঝলসে উঠছে...খ্যাঁচ খ্যাঁচ, ছবি উঠছে। মুখ থুবড়ে পড়া যুদ্ধ বিমানের সামনে ইলিয়াস থেকে রাধামাধব সবাই এক বার ছবি তুলিয়ে রাখতে চাইছেন। বিমানের গায়ে হাত ছুঁইয়ে কোমর বেঁকানো ছবি, চাট্টিখানি কথা। সেনপাড়ার নবম শ্রেণি এক ধাপ এগিয়ে বেনি দুলিয়ে দিব্বি জড়িয়ে ধরল বিমানের ডানা, ছবিও উঠল ‘বয় ফ্রেন্ডের’ মোবাইলে।
মেলায় হিড়িকে তিল খেতের দফারফা। তা কে শোনে? রাইগ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য প্রদীপ ঘোষ বলেন, “মানুষকে রুখব কী করে! আমার তিল ভেঙে মানুষ যদি একটু মেলায় আসেন, তা কী নিষেধ করা যায়!” |
গ্রামের সুব্রত ঘোষ মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন, “একটু যদি ক্ষতিপূরণ পাওয়া যেত...” তা কে শুনছে সে কথা। প্রশাসন কর্ণপাতই করেনি। সুব্রতবাবুরা এখন হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে রয়েছেন, কবে ডানা মেলবে যুদ্ধ বিমান। তারপর সেই যুদ্ধ বিদ্বস্ত জমিতে ফের বুনবেন তিল, সর্ষে।
স্থানীয় ব্লক অফিস থেকে অবশ্য সে ব্যাপারে কোনও ভরসা মেলেনি। ভরতপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও বলছেন, “কবে উড়বে, কী করে বলি বলুন। দু-দেশের প্রতিনিধিরা এসে সরজেমিন দেখবেন, বিশেষজ্ঞরা আসবেন। তারপর তো সিদ্ধান্ত।” ইতিমধ্যেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনা তিনেক উড়ান-বিশেষজ্ঞ ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের হাবভাব দেখে আরও মুষড়ে পড়েছেন সুব্রতবাবুরা। সার বুঝেছেন, বিমান উড়তে ঢের দেরি। তত দিন মেলা বহাল। মেলা অবশ্য বরাত খুলে দিয়েছে বাবর আলির। স্থানীয় গুলহাটিয়া মোড়ে ঝালমুড়ি বেচে সামান্য আয় হত, এখন মেলায় বিক্রি দ্বিগুণ। বাবর বলছেন, “বিমান মেলা জিন্দাবাদ। জানেন গুলহাটিয়া মোড়ে বিকেল থেকে সন্ধে বেচাকেনা ছিল বড়জোর দেড়শো টাকা। এখন বেচছি তিনশো টাকার মুড়ি!” শ্রীমন্ত দাসের আইসক্রিমও দেদার বিকোচ্ছে। “আইসক্রিম খেতে খেতে বিমান দেখার মজাই আলাদা”, সালিন্দার স্কুল ছাত্রীদের এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে সে কি হাসি।
রাইগ্রামের প্রদীপবাবুকে মাথায় রেখে জনা কুড়ি ছেলে নিয়ে প্রশাসন গড়ে দিয়েছে একটা মেলা কমিটি। তাঁরা ভিড় সামাল দিতে হিমশিম। বাঁশের ঘেরাটোপে সরু এক ফালি যুদ্ধ বিমানের কাছাকাছি যাওয়া বারণ। কে শোনে? ভলেন্টিয়ারের গলায় ক্ষোভ ঝরে, “প্রথম দিকে শুনছিল জানেন, এখন কেউ কথাই শোনে না, আমরাও আর বাধা দিই না।”
গাজন মেলা শেষ। তা হোক বিমান মেলা তো চলছে।
ধুলো উড়ছে, মাঠ তে তে উঠছে, মেলা চলছে, বিমান তো আর উড়ছে না! |