|
|
|
|
দিল্লি ফতে এবং নাইটরা একে |
গৌতম ভট্টাচার্য • নয়াদিল্লি |
ঠিক বত্রিশ দিন আগে ইডেনকে স্তব্ধ করে যাদের কাছে উদ্বোধনী আইপিএল অভিযানে হেরেছিল, আজ তাদের পাড়ায় গিয়ে মেরে গেল কলকাতা নাইট রাইডার্স। ইডেনে যে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস জিতেছিল তার তুলনায় এটা অনেক শক্তিশালী, পয়েন্ট তালিকায় সবার ওপরে থাকা দল। তাকে কোটলায় ৬ উইকেটে উড়িয়ে দেওয়ার পর নাইটদের সম্পর্কে এ যাবত তৈরি হওয়া ‘শ্রদ্ধা’ স্টেশনটা চলে গেল পরের স্টেশনে। যার নাম ‘আতঙ্ক’।
পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে চলে যাওয়া নাইটদের আপাতত চারটে ম্যাচ বাকি। অঙ্কের পারমুটেশন-কম্বিনেশনে এখনও তাদের সেমিফাইনাল যাত্রা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়। কিন্তু ধরে নেওয়া যায় দিল্লির যে এলাকায় তাঁর বেড়ে ওঠা, সেই গুলমোহর পার্ক থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের কোটলায় নতুন প্রাপ্তির সোপানে হাত রাখলেন শাহরুখ খান। ভাগ্য অবিশ্বাস্য রকম বিশ্বাসঘাতকতা না করলে গৌতম গম্ভীরের নেতৃত্বে আবার তাঁর দল উপর্যুপরি সেমিফাইনালে যাচ্ছে।
ইডেনে কেকেআর যেমন শেষ দশ ওভারের ব্যাটিং ব্যর্থতায় পুণের হাতে ম্যাচটা সাজিয়ে দিয়েছিল, এখানে দিল্লি তেমনি দারুণ শুরু করেও ম্যাচটা দিয়ে গেল নাইটদের। তফাতের মধ্যে পুণে সুযোগ নিতে পারেনি। নাইটরা কোটলায় নিল। |
|
(১৮.৪ ওভারে) ৯ বলে ২৩-এর ঝড় থামালেন কালিস। সোমবার কোটলায় সহবাগকে ফিরিয়ে। ছবি: এপি |
|
১৫৩ তাড়া করতে নেমে গম্ভীররা প্রথম থেকেই বল পিছু রান নীতিতে দৌড়েছেন। গম্ভীর-ম্যাকালাম জুটি ফের কাজ করল। ম্যাকালাম করলেন ৪৪ বলে ৫৬। গম্ভীর ২১ বলে ঝোড়ো ৩৬। এমনকী জাক কালিস, যাঁর টুর্নামেন্টে স্ট্রাইক রেট যাচ্ছিল ৯৬, তাঁর আজ স্ট্রাইক রেট দাঁড়াল ১১১। উমেশ যাদব একটা স্পেলে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে টেস্ট ম্যাচ বোলিং শুরু না করলে এই ম্যাচটা কেকেআর ৯ উইকেটে জেতে।
দিল্লির ইনিংস শেষ হওয়া মাত্র স্থানীয় কয়েক জন সাংবাদিক ছুটে এলেন। জিজ্ঞাস্য, গৌতম গম্ভীরের আজ কী হয়েছে?
এঁরা গম্ভীরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে নাকি তাঁকে নাগাড়ে এত উত্তেজিত কখনও দেখেননি। আর তাই জানতে চান কেকেআর শিবিরে কি কোনও গণ্ডগোল হয়েছে? নইলে প্রথম থেকে গম্ভীর এত ক্ষেপে থাকা কেন?
মনে হল না শিবিরের কোনও অশান্তির কারণ বলে। সম্ভবত নিজের শহরে তেজিয়ান দিল্লিকে দিল্লির মতো আক্রমণমুখী থেকে হারাবেন, এই ভাবনা থেকেই তৈরি তাঁর আজকের মনোভাব। খেলার পর নিজেও তাই বললেন, “ড্রেসিংরুমে ফিরে দুঃখ দেখতে একটুও ভাল লাগে না। আর ড্রেসিংরুমে সুখ দেখার জন্য মাঠে আক্রণমাত্মক হওয়াটা খুব জরুরি। আমি সেটাই করেছি।”
কিন্তু কেকেআর অধিনায়ক যতই ব্যাখ্যা দিন, সময় সময় গম্ভীরকেন্দ্রিক উত্তেজনা এমন মাত্রায় চলে গেল যে খেলার পর ম্যাচ রেফারির এজলাস তাঁর অনিবার্য ঠিকানা হতেই পারে। কেকেআরের অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান ওয়ার্নার আউট হওয়ার পর উত্তেজিত ভাবে দৌড়ে এলেন। এর পর মাহেলার সঙ্গে তর্কাতর্কি হল। মাহেলাকে রানআউট করে শুয়ে-শুয়েই কী সব বললেন। যা স্টাম্প মাইক্রোফোন তুলে থাকলে বাচ্চাদের কোচিং ক্যাম্পে মোটেও বাজানো উচিত হবে না। রস টেলর আউট হতে আবার তিনি তেড়ে এলেন। তাঁর এবং সহবাগের বন্ধুত্বের ওপর ভিত্তি করে ধারণা হচ্ছিল একটা প্রীতি ম্যাচের আবহ থাকবে। দুপুরে দিল্লির স্থানীয় এফএম-এ রেডিও জকিরা অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন, আজকের খেলা দিল্লি বনাম দিল্লি। রাতে রামিজ রাজা তাঁর মতো করে বর্ণনা দিলেন, আজ কোটলায় বীরু বনাম জয়। আর শুকনো বাস্তববাদীরা বললেন, পয়েন্ট তালিকায় এক বনাম দুই!
গত বার থেকেই আইপিএলে সেমিফাইনাল খেলা হচ্ছে নতুন প্লে-অফ পদ্ধতিতে। বরাবরের সিস্টেম আর নেই যে সেমিফাইনালে একের বিরুদ্ধে খেলবে চার। দুইয়ের বিরুদ্ধে খেলবে তিন। এখনকার পদ্ধতি হল, এক আর দুই সরাসরি খেলবে। যারা জিতবে ফাইনাল চলে গেল। যারা হারল তারা মোটেও বিদায় হল না। বরঞ্চ অপেক্ষা করল তিন বনাম চারের উইনারের জন্য। এ বার দুই বনাম তিন / চারের বিজয়ী ম্যাচে জয়ী উঠে গেল দ্বিতীয় দল হিসাবে ফাইনালে!
ধরে নেওয়া হচ্ছে এ পর্যন্ত যা আভাস, দিল্লি ভার্সেস কলকাতা হবে প্রথম সেমিফাইনাল, পুণেতে। তার আগে কোটলায় এই ম্যাচটা ছিল ড্রেস রিহার্সাল। মহড়ায় কি সব তাস ফেলে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে? সোমবার এই আলোচনায় কেকেআর শিবির দীর্ঘক্ষণ আক্রান্ত ছিল।
বিষয় সুনীল নারিন। টুর্নামেন্টের যিনি মিস্ট্রি বোলার। কোটলার মতো ছোট মাঠ আর ব্যাটিং উইকেটে তাঁকে সহবাগের সামনে ফেলা উচিত হবে? না কি ধরে রাখা হবে প্লে-অফ ম্যাচের জন্য? অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় কোনও অধিনায়ক হলে আস্তিনে তাসটা লুকিয়ে রাখতেন। গৌতম গম্ভীর রক্ষণশীল মানসিকতার। দিল্লির কুতুব মিনার সদৃশ ব্যাটিং লাইনআপের সামনে নারিনকে নামিয়েই দিলেন। বিকেল পাঁচটার টিম মিটিংয়ে যাওয়ার আগে জনৈক কেকেআর ক্রিকেটার ক্যাপ্টেনের সমর্থনেই দাঁড়ালেন: আরও এক পয়েন্ট বাকি আমাদের সেমিফাইনাল যাওয়া নিশ্চিত করতে। বাকি চারটে ম্যাচ। তার মধ্যে দুটো মুম্বই। একটা চেন্নাই। খুব টাফ। পুণের সঙ্গেও ফিরতি ম্যাচ বাকি। এ বার ওরা সহজে ছেড়ে দেবে না। কী গ্যারান্টি যে এক পয়েন্ট হবেই। দিল্লির সঙ্গে তাই ফুল টিম নামানো উচিত!
সহবাগ বনাম গম্ভীর দেখার জন্য কোটলা যথারীতি হাউসফুল বোর্ড ঝোলাল। তবু খেলা শুরুর আগে মাঠে ঢুকতে গিয়ে মনে হল, লোক তো ধীরে ধীরে ঢুকছে। কিন্তু মনোভাবের সেই তীব্রতা কোথায়? কোথায় সেই ব্যাকুল পাগলামি? ৫ মে-র ইডেন যদি রোববার সাড়ে ন’টার ভরপুর গড়িয়াহাট বাজার হয়, এ কোটলা তো পার্ক স্ট্রিটের সমাধিক্ষেত্র! প্রাণপণ আকুতিটাই তো গরহাজির!
সমাধিস্থলকে অবশ্য সহবাগ দ্রুত জীবন্ত করে দিলেন তাঁর আক্রমণ-আক্রমণে। ঠিক এই সময় ভিনরাজ্যের অতিথির দিল্লিতে প্রিয় খাবার কী হতে পারে? করিমসের বিরিয়ানি। জামা মসজিদের সামনে কাবাব। চাঁদনি চকের কুলফি। সহবাগের প্রিয় খাদ্য অবশ্য আইপিএল সিজনে থেকে যাচ্ছে একটাই। দিল্লিতে যারাই খেলতে আসুক, তাদের বোলিং!
অরেঞ্জ ক্যাপ এ দিন ফের ছিনিয়ে তো নিলেনই। যে ভঙ্গিতে নাইটদের জবাই শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল ৫ মে-র হানিমুন একাই নিকেশ করে দেবেন। তখনও বোঝা যায়নি ইনিংসটা থেমে যাবে মাত্র ৯ বলে ২৩ করে। তাঁর পর নেমে মাহেলা জয়বর্ধনেও যখন একই রকম মারমার, তখন বোঝা গেল দিল্লি এই ম্যাচকে নিবিড় আক্রমণের মডেল হিসেবে ছকেছে। যাতে ক্রমাগত মেরে সম্ভাব্য প্লে-অফের জন্যও নাইটদের মনোভাবটা গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। ম্যাচ শেষে ইরফান পাঠান স্বীকারও করলেন, “বাকি অন্য ম্যাচ যা হোক, এটা আমরা ভীষণ ভাবে জিততে চেয়েছিলাম। আবার তো প্লে অফে দেখা হতে পারে।” অর্থাৎ একটা ম্যাচে নেমে দিল্লি খেলছিল দু’টো ম্যাচ!
খেলা শুরুর আগে ব্রেট লি-মনোজ তিওয়ারিরা টুইট করছিলেন সেটা আশ্চর্যের নয়। সব দিনই প্লেয়াররা নিজের নিজের খেলার আগে করছেন। বিচিত্র যেটা, দেখলাম ক্রিস গেইল আর বিরাট কোহলিও টুইট করেছেন যে, বড়দের খেলা রাত আটটা থেকে।
তার মানে কী? গ্যালারিতে উত্তেজনা যতই ইডেন অনুপাতে শিশু চলচ্চিত্র উৎসব হোক। গোটা দেশের আইপিএল সমাজ তার মানে টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে দেখতে বসে যাবে। বীরু-জয় বন্ধুত্ব কী, তারা দ্রুতই দেখল গম্ভীর উত্তেজিত হয়ে গিয়েছেন। প্রচণ্ড শাসানি-পাল্টা শাসানি চলল তাঁর জয়বর্ধনের সঙ্গে, উপলক্ষ কট বিহাইন্ডের আবেদন নাকচ হওয়া। ম্যাচটাও তেতে গেল। খেলার পর গম্ভীর ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করলেন। বললেন, “মাঠে এ সব হয়েই থাকে। টুকরোটাকরা কথা।” কিন্তু দেখে বেশ বোঝা গেল কেকেআর অধিনায়ক কাপ জয়ের জন্য যেন সর্বস্ব পণ করে বসে আছেন। টিমের সিইও বেঙ্কি মাইসোর যখন বলছেন, প্লে অফ আশা করি হয়ে যাচ্ছে, তখন গম্ভীরের বক্তব্য, “আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। বাকি সব ক’টা ম্যাচ জিততে হবে।”
পুনশ্চ: মাঝরাত্তিরে আন্দাজ পাওয়া গেল, ম্যাচ চলাকালীন গম্ভীরের গুস্সা কী কারণে উৎপন্ন হচ্ছিল। শোনা গেল, দিল্লি টিম ছেড়ে আসা নিয়ে টিম মালিক জিএমআর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর কিছু ব্যাপারে প্রবল মতান্তর হয়। তাই কোটলার ম্যাচটাকে গম্ভীর মর্যাদাযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিলেন। সে জন্যই বাড়তি টগবগে ছিলেন। মর্মার্থইডেনে শোধ তোলার পর্বটা হল না, কোটলারটা হল।
|
|
|
|
|
|
|