পাহাড়ের ‘মন পেতে’ এ বার বেসরকারি সহযোগিতায় মেডিক্যাল কলেজ গড়তে চাইছে সরকার। ঠিক হয়েছে, কার্শিয়াংয়ে শশীভূষণ দে যক্ষ্মা স্যানাটোরিয়াম বন্ধ করে সেখানেই হবে নতুন মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত উস্কে দিয়েছে কিছু প্রশ্ন।
হঠাৎ পাহাড়ে মেডিক্যাল কলেজ কেন? স্বাস্থ্য-কর্তাদের বক্তব্য, ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ)-চুক্তির সময়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতারা পাহাড়ে একটি মেডিক্যাল কলেজের দাবি তোলেন। শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও পাহাড়ের মানুষের পক্ষে সেখানে রাতবিরেতে যাতায়াত কষ্টসাধ্য। সেই অসুবিধে দূর করতেই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে মেডিক্যাল কলেজ গড়ার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। তার পরেই কার্শিয়াঙের ওই হাসপাতালের জমিটি চিহ্নিত হয়। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গোর্খাদের জন্য আলাদা আসন রাখার বিষয়টিও এক রকম চূড়ান্ত হয়েছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, প্রায় ৩২ একর জমিতে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে গড়ে উঠবে মেডিক্যাল কলেজ। সরকার বিনামূল্যে জমি দেবে। পরিকাঠামো গড়া এবং যাবতীয় নিয়োগের যাবতীয় দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার। জমির বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজে ১০% শয্যা সরকারের পাঠানো দরিদ্র রোগীর জন্য বরাদ্দ থাকবে।
বেসরকারি সংস্থাগুলি যাতে এই প্রকল্পে আগ্রহ দেখায় তাই আগামী ১০ মে একাধিক বণিক সংগঠনের সঙ্গে স্বাস্থ্যভবনে বৈঠকে বসবেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা। ২০১৩-১৪ সালের মধ্যে এই মেডিক্যাল কলেজ চালু করা হবে বলেও দাবি করেছেন তিনি। কার্শিয়াঙের মোর্চা বিধায়ক রোহিত শর্মা বলেন, “জিটিএ-র অগ্রাধিকারের তালিকায় মেডিক্যাল কলেজ গড়ার বিষয়টি রয়েছে। সে জন্য কার্শিয়াঙে ইতিমধ্যেই থাকা পরিকাঠামোর কথা মাথায় রেখে এগোনো হচ্ছে। এটা তাড়াতাড়ি করাতেই হবে।”
কিন্তু এই নতুন মেডিক্যাল কলেজ গড়াকে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কারণ?
প্রথমত, রাজ্যে তিনটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ গড়তে গিয়ে কার্যত ‘নাকানিচোবানি’ খাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, বহরমপুর মেডিক্যাল এখনও মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদনই জোগাড় করতে পারেনি। মালদহ ও সাগর দত্ত মেডিক্যালের নির্মাণকাজ শেষ হতে এখনও অনেক বাকি। এই অবস্থায় আরও একটি মেডিক্যাল কলেজ কি বাড়তি ঝুঁকি হয়ে যাবে না? ‘নাকানিচোবানি’ খাওয়ার বিষয়টি মানতে চাননি স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা। তাঁর দাবি, “কার্শিয়াংয়ের বিষয়টি আলাদা। কারণ, এখানে পরিকাঠামো নির্মাণ, নিয়োগ সবই করতে হবে বেসরকারি সংস্থাকে। সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই।”
দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজ সরকার গরিব রোগীর চিকিৎসার জন্য ১০ শতাংশ শয্যা পাবে বলে বলা হচ্ছে। এই একই শর্ত যাদবপুরে কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ বা তার আগে আমরি-সহ একাধিক হাসপাতালের ক্ষেত্রেও রাখা হয়েছিল। কোনও ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ১০% শয্যায় গরিব রোগীরা নিখরচায় পরিষেবা পাচ্ছেন কি না, তা নজরদারি করেনি সরকার। কার্শিয়াংয়ের ক্ষেত্রে নজরদারি করা যাবে? স্পষ্ট বলেনি স্বাস্থ্য দফতর।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি, যক্ষ্মা হাসপাতালটির ২০০ শয্যায় গড়ে ৪০-৫০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। হাসপাতাল উঠে গেলে তাঁরা যাবেন কথায়? যক্ষ্মা চিকিৎসকদের একাংশ জানিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যক্ষ্মা রোগীরা খুব গরিব পরিবার থেকে আসেন। হাসপাতালে থাকলে তবু দু’বেলা তাঁরা খাবার এবং নিয়মিত ওষুধ পান, যা সুস্থ হওয়ার জন্য খুব দরকার। কোনও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ওই ধরনের রোগীর বাড়ি হলে, সেখানে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী (ডট প্রোভাইডার) তাঁকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াবেন, এমন নিশ্চয়তা থাকে না।
তবে কার্শিয়াঙের মোর্চা বিধায়কের দাবি, যক্ষ্মা হাসপাতালটিতে এখন গড়ে ৮-১০ জনের বেশি যক্ষ্মা রোগী থাকেন না। বেশির ভাগই বাড়িতে চিকিৎসা করাতে চান। দার্জিলিঙের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিক বলেন, “এখন ডট পদ্ধতির চিকিৎসায় হাসপাতালে থাকতে হবে বলে বাধ্যবাধকতা নেই। বাড়িতেই চিকিৎসা হতে পারে।” তাঁর আশ্বাস, “জরুরি হলে জলপাইগুড়িতে রানি অশ্রুমতি যক্ষ্মা হাসপাতাল বা বাতাসিয়া যক্ষ্মা হাসপাতালে রোগীদের রাখার ব্যবস্থা করবে জেলা স্বাস্থ্য দফতর।” |