স্বর্গের পারিজাতবনে শিবদাস ভাদুড়ি, গোষ্ঠ পাল, উমাপতি কুমারের সঙ্গে শৈলেন মান্নার দেখা হলে আজ তাঁরা কৌতূহলী প্রশ্ন করতে পারেন। “ওহে মান্না, এই হোসে ব্যারেটো ছেলেটি কে? আমাদের মধ্যে তুমিই তো শুধু ওকে দেখেছ!”
স্বর্গ থেকে শনিবার সকালের মোহনবাগান মাঠের ছবিটা দেখে তাঁদের চোখেমুখে মুগ্ধতা ফুটে উঠত। “আহা, আমাদের সময় তো কেউ এ ভাবে বিদায় জানায়নি!”
আর গোষ্ঠ পাল সরণির সবুজ আবহে মোহনবাগান ক্লাবের অন্য তিন জীবন্ত মুখের কথাতেও সেই মুগ্ধতা।
কী ভাবে একটা বাক্যে ব্যাখ্যা করবেন হোসে ব্যারেটোকে? তিন জনকে প্রশ্ন করে এমন উত্তর মিলল।
চুনী গোস্বামী: ফুটবল ও মোহনবাগানের স্বার্থে দারুণ অবদান।
সুব্রত ভট্টাচার্য: একেবারে নিখুঁত বাঙালি চরিত্র।
সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ফুটবলার ও মানুষ হিসেবে একটা গভীর বার্তা ভারতীয় ফুটবলে।
গার্ড অব অনার, চোখের জল, ফুলের মালা, স্লোগান, হাহাকার মিশে গেল বাগানে ওই লোকটার শেষ অনুশীলনে।
সবুজ তোতা শিকল ছিঁড়ে ফেলল শনিবার! আজ যুবভারতীতে সে একেবারে উড়ে যাবে বাগান ছেড়ে।
কী আশ্চর্য, ব্যারেটোর শেষ প্র্যাক্টিসে মোহনবাগান মাঠের উপর উড়ে বেড়ালো গোটা তিনেক সবুজ টিয়া। সশব্দে। ওটাও কি কান্নার শব্দ? যে শব্দ শোনা যাচ্ছিল ব্যারেটো-ভক্তদের ডুকরে ওঠা কান্নায়। |
মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন সব সতীর্থ। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন মালা। দূরে প্র্যাক্টিস করছিল সিএফসি ক্লাবের ফুটবলাররা। সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁদেরও ডেকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন লাইন দিয়ে। প্র্যাক্টিসের জার্সিটা খুলিয়ে ব্যারেটোর গায়ে পরিয়ে দিলেন নতুন একটা সবুজ-মেরুন জার্সি।
ওডাফা আর সুব্রত মালাটা পরাতেই কেঁদে ফেললেন ব্যারেটো। সব সতীর্থকে গিয়ে জড়িয়ে ধরছিলেন। মালায় মালায় ঢেকে ব্যারেটো যখন বেরিয়ে আসছেন, সেই রাস্তার দু’ধারে তাঁর সতীর্থরা এসে তুলে ধরেছিলেন বুট। ফুল ছড়ালো কেউ। ব্যারেটোর নামে স্লোগান। ঠিক এ ভাবেই ব্রায়ান লারা, মুরলীধরন, স্টিভ ওয়দের বিদায় জানিয়েছিল না সতীর্থ ক্রিকেটাররা? ভারতীয় ফুটবলে এমন হয় তা হলে!
রাধাচূড়া, সোনাঝুরি, কৃষ্ণচূড়ার ঝরা পাপড়ির উপর দিয়ে বিহ্বল ব্যারেটো বেরিয়ে গেলেন মাঠ ছেড়ে। মোহনবাগান ফুটবলার হিসেবে চিরকালের জন্য। পাশে সুব্রত। পিছন পিছন অজস্র মানুষ। কান্না ঢাকতে ব্যারেটো ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন। চোখে হাত। অস্বস্তি মুছতেই দ্রুত হাঁটা।
আজ কেউ বলছে না, পুণে এফসি-র সঙ্গে ম্যাচটা জিততেই হবে। আজ কেউ বলছে না, সুব্রত পালকে টপকে গোল দিতে হবে। আজ ব্যারেটোর মতো অনেক ফুটবলারেরই শেষ দিন। সে প্রসঙ্গও কেউ তুলছে না। আজ কারও মুখে স্লোগান, ‘‘ইন ব্যারেটো, উই ট্রাস্ট’। কেউ ব্যারেটোর ছবিওয়ালা ফ্লেক্স পেতে রয়েছে, যেখানে লেখা পুরনো লোকসঙ্গীতের লাইন, “তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না।” কেউ ব্যারেটোর সামনে পেতে দিচ্ছে বুক এখানে সই দাও। এরপরে ভবানীপুরে খেলবেন ব্যারেটো। দেখে মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, একেবারে যেন শেষ বিদায় জানাচ্ছেন ফুটবলকে।
সবাইকে এ ভাবেই চলে যেতে হয় এক দিন, বয়স কাউকে ছাড়ে না! মোহনবাগান তাঁবু থেকে শেষ প্র্যাক্টিস সেরে বেরনোর মুখে ছলছল চোখে ব্যারেটো, “একই সঙ্গে খারাপ লাগছে, ভালও লাগছে।” তাঁর পাশে বাধ্য ছাত্রের মতো বসে সুপারস্টার ওডাফা। বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেছে তাঁকেও। ব্যারেটোর গলাও নিচু, “মোহনবাগানকে ওডাফার হাতে দিয়ে গেলাম। দারুণ ফুটবলার, দারুণ নেতা। আশা করি, গোল করবে। ট্রফিও আনবে। যা গত দু’তিন বছর হয়নি। ওটাই দুঃখ একটা।” ওডাফার মুখে বিস্ময়, “এমন বিদায় সংবর্ধনা কোনও খেলায় দেখিনি। বুঝতে পারছি, এখানে ব্যারেটোর জায়গাটা কোথায়।”
ব্যারেটোর শেষ দিনে ভক্তরাই সব আবেগ রচনার দায়িত্বে। যে আবেগের রাজপথ তৈরি করে দিলেন সুব্রত। প্র্যাক্টিসের আগে টিমমিটিংয়ে বলেছিলেন, ব্যারেটোর জন্যই জিততে হবে। প্র্যাক্টিস শেষে অভিনব বিদায়ের পরিকল্পনা তাঁরই তৈরি। তাঁবু ছাড়ার সময় বিখ্যাত গোল টেবিলে ফুটবলারদের ডেকে ব্যারেটোর হাতে সুব্রত তুলে দিলেন অজস্র উপহার। “আমার কোচিংয়ে মোহনবাগানে প্রথম খেলেছে ও, শেষ ম্যাচও খেলবে। আমি গর্বিত। আমার স্ত্রী সব কিনেছে ওর জন্য।” আপনার নিজের শেষ প্র্যাক্টিস মনে আছে.? সুব্রত: আমার শেষ ম্যাচে লোক উপচে পড়েছিল। শেষ প্র্যাক্টিসে প্রদীপদা কিছু করেনি। তাই মনে হয়েছিল, ব্যারেটোর শেষ প্র্যাক্টিসটা স্মরণীয় করা দরকার। ও তো আই লিগে যে কোনও ক্লাবে দু’বছর খেলতে পারত।”
তাঁবুর সামনে গাড়িতে বসে পনেরো মিনিট সই দিতে হল নাগাড়ে। বহুক্ষণ পরে ব্যারেটোর গাড়ি যখন স্টার্ট নিল, প্রচুর সমর্থক তাকিয়ে রইলেন গাড়ির দিকে। ওই চলে যাচ্ছে ব্যারেটো। ওই যে, ওই যে!
আর তাঁবুর বাইরের অজস্র ব্যারেটো ভক্ত? হুগলির প্রবীণ মোহনবাগান সমর্থক রঞ্জিত কুমার ঘোষ পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে পাঁচ গোলে হারের পরে মোহনবাগানের ঘরোয়া ম্যাচ দেখতে যাননি আর। ক্ষোভে, দুঃখে, হতাশায়। পেলের জন্য মোহনবাগান-কসমস ম্যাচ দেখেছিলেন ৩৫ বছর আগে। ব্যারেটোকে দেখেছেন শুধু টিভিতেই। তিনি রবিবার গুরুত্বহীন ম্যাচে আসছেন শুধু ব্যারেটোর শেষ সংবর্ধনার সাক্ষী হতে। “শুধু ব্যারেটোর সংবর্ধনা দেখব। তার পরে চলে যাব। ম্যাচটা দেখব না।” যুবভারতীতে প্রথম পা রাখতে যাওয়া রঞ্জিতবাবুর গলায় ব্যারেটো-আবেগ। সেই আবেগ বর্ধমানের সুদীপ পাল, নৈহাটির চিরন্তন রায়ের মুখে। কবে শেষ মোহনবাগানকে দেখেছেন, ভুলে গেছেন। আজ যাবেন। গুরুত্বহীন ম্যাচ যে হয়ে গিয়েছে লোকগাথার, ব্যারেটোগাথার!
ওই আবেগটা নতুন প্রজন্মের হাজার হাজার তরুণেরও। তাঁদের ফেসবুক ওয়াল ভরে গিয়েছে ব্যারেটোর ছবিতে। গানের লাইন ও কবিতায়। ‘সে নাম রয়ে যাবে’, ‘শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চেয়েছি’, ‘হৃদয়ের এ-কূল ও-কূল দু’কূল ভেসে যায়’।
যে লাইনটা ফেসবুকে চোখে পড়ল না, সেটাই মোহনবাগান-জনতার মনের কথা। ‘ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়’।
সবুজ তোতা উড়ে যাচ্ছে! আজকের পরে আর ফিরবে না বাগানে। |