সাতশো বারো বর্গ কিলোমিটার। এটাই সিঙ্গাপুরের আয়তন।
কিন্তু বড় হওয়ার ইচ্ছা? তাগিদ? পরিশ্রম? দেখে এলেন
অনিন্দ্য জানা |
এখানে পুলিশ নেই বুঝি? পাঁচ-পাঁচটা দিন কেটে গেল। রাস্তাঘাটে, গাছের আবডালে বা কোনাখামচিতে এক জনকেও তো দেখলাম না!
শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী লিম কিয়াং মোলায়েম হাসলেন, “আছে তো।”
আছে! কোথায়?
“আছে। আছে। আমি বরং বলব, আমাদের পুলিশের আরও তৎপর হওয়া উচিত। কমিউনিটি পুলিশিং-টা আরও ভাল হওয়া উচিত”, প্রবীণ রাজনীতিককে যথেষ্ট সিরিয়াস শোনাল।
হতে পারে। কিন্তু আমি তো তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক। সারা গায়ে পুলিশ-পুলিশ গন্ধ। আস্ত একটা শহর চলছে তেল-খাওয়ানো মেশিনের মতো। সোঁ-সোঁ গাড়ি চলছে। ট্র্যাফিক সিগনালে নিয়ম মেনে দাঁড়াচ্ছে। পথচারীরা পেরোচ্ছেন। কোথাও বিন্দুমাত্র টোল খাচ্ছে না কিছু। বিরক্তিকর প্যাঁ-পোঁ হর্ন নেই। তকতক করছে রাস্তাঘাট। ধুলো বলতে সিগারেটের ছাই। কারণ সিগারেটের শেষাংশ জমা পড়ছে রাস্তাতেই ৫০ ফুট অন্তর-অন্তর রাখা ডাস্টবিনে (ব্যতিক্রম হলে কড়া শাস্তি। শৃঙ্খলাটা খুব কঠিন। দোষ করলে শাস্তি নির্ঘাত। এবং অত্যন্ত দ্রুত। ফলে লোকে আইনকে ভয় পায়! মান্যিও করে)। কানে গোঁজা আইফোনের ইয়ারপ্লাগ। হাতে আইপ্যাড। রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত পেশাদারেরা। পাশে পাশে হাঁটছে খুশিয়াল পর্যটকের ভিড়। |
সাধে বলে, আমেরিকা দেখতে হলে বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। সিঙ্গাপুর দেখে এলেই হল!
সাকুল্যে ৭১২ বর্গ কিলোমিটার স্থলভূমির একটা দ্বীপ। জনসংখ্যা মেরেকেটে ৬০ লক্ষ। যাঁদের মধ্যে ৪০ লক্ষ মতো সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং পাকাপাকি ভাবে দেশটায় থাকেন। মানে, নেহাতই পুঁচকি। বিনয় করে সিঙ্গাপুরের লোকজন বলেন, “ছোট বলেই বোধহয় লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করা সুবিধার। আপনাদের মতো বিশাল দেশে ওটা অসম্ভব!” কথাটা সম্ভবত পুরো বিনয়ও নয়। সত্যিই তো! দেশটা বড্ড ছোট। সে কারণে লোকসংখ্যা আয়ত্তের মধ্যে। সম্ভবত তাই শাসনের মডেলটাই আলাদা।
কিন্তু আমি তো আবার তৃতীয় বিশ্ব! তা-ও সিঙ্গাপুর থেকে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার উড়ান দূরত্বের এক শহরের বাসিন্দা! তিনশো বছরেরও প্রাচীন এক শহরের বাসিন্দা বিস্ফারিতনয়ন মাত্র ১৯৬৫ সালে স্বাধীন-হওয়া এক রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে। নয়ন বিস্ফারিত হয় সেই দেশের (নাকি, শহরই বলব?) মাঝ বরাবর বয়ে-যাওয়া এক স্বচ্ছ, টলটলে নদী দেখে। সিঙ্গাপুরের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের অফিসার ই লিনের কথা শুনে চমকিতও বটে “দশ বছর ধরে আমরা এই নদীটাকে সাফসুতরো করেছি।”
দ-শ-ব-ছ-র! বলেন কী?
ছোটখাটো চেহারার তরুণী হাসেন, “ঠিক শুনছেন। দশ বছর।” তার পর জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে তিন দশকের পুরনো সিঙ্গাপুর রিভারের সাদাকালো বিবর্ণ ছবি দেখান। দু’পাশে অজস্র ঝুপড়ি। উইয়ে-খাওয়া, পুঁইয়ে-পাওয়া, নেই-আঁকড়া চেহারার লোকজন ঘুরছে। ছবি দেখে তৃতীয় বিশ্বের এক বুড়ি শহরের বাসিন্দার ঝপ করে মনে পড়ে, তার শহরের জনসংখ্যা ৫১ লক্ষের কিছু বেশি। মনে পড়ে, তার শহরেরও মাঝ-বরাবর বয়ে যাওয়া এক জলধারার কথা। মনে পড়ে টালির নালার (না কি ‘আদিগঙ্গা’) দু’পাশে আবর্জনার স্তূপ। ধক করে নাকে লাগে পচা পাঁকের গন্ধ। মনে পড়ে, মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের জন্য সেই নালার দু’পাশের ঝুপড়ি উচ্ছেদ করতে গিয়ে তাঁর দলের নেত্রীর কাছেই কী প্রবল বাধা পেয়েছিলেন শহরের তৎকালীন মেয়র!
প্রশ্ন আসে, ওই সব লোকজনকেও তো উচ্ছেদ করতে হয়েছিল। সমস্যা হয়নি? গোলমাল? সংঘর্ষ? এত সহজে কেউ মেনে নিয়েছিল?
সিঙ্গাপুর রিভারের উপর চালু আধুনিক নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ জবাবও আসে হয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে বোঝাতে পেরেছি যে, যা হচ্ছে, তা দেশের ভালর জন্য। তাদেরও ভালর জন্য। মানুষ বোঝেন। তাঁরা তো আর নির্বোধ নন।
তৃতীয় বিশ্ব তখনই ভোম্বল। কিন্তু মেরিনা বে-তে পৌঁছে মনে হল, এর তুলনায় সিঙ্গাপুর রিভার প্রজেক্ট তো নেহাতই বেবিফুড-পুষ্ট শিশু! দেশের আয়তন কম। কিন্তু বাড়ন্ত যে! অতএব সমুদ্র থেকে জমি বার করে নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়েছিল। তারই পোশাকি নাম মেরিনা বে। সমুদ্রের মধ্যে বাঁধ দিয়ে জলকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। ১৯৭৭ সালে যে প্রকল্প শুরু হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে এই সে দিন ২০০৭ সালে। তার পরের পাঁচ বছরে গোটা এলাকাটা গর্বোদ্ধত মাথা তুলেছে সিঙ্গাপুরের আকাশে। অসংখ্য ঝকমকে স্কাইস্ক্রেপার-সমন্বিত যে আকাশরেখায় রোজ এক অপার্থিব বিভ্রম ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যায়।
কিয়াং বলছিলেন, “সমুদ্রের মধ্যে দেওয়াল তুলে এলাকাটাকে আলাদা করে ফেলা হয়। তার পর তিরিশ বছর ওই ভাবেই ফেলে রাখা হয়। তাড়াহুড়ো করা হয়নি। জল চুঁইয়ে বেরিয়েছে নিজের মতো।” তার পর মাটির বসন হয়েছে। বার বার ‘সয়েল টেস্ট’ হয়েছে। দেখা হয়েছে, জমি আধুনিক এবং অতিকায় নির্মাণের ভার বহনের জন্য উপযুক্ত হল কি না। গাদা গাদা বিদেশি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসা হয়েছে। তত দিন দেশের মানুষ দম ধরে অপেক্ষা করেছেন। ২০০৭ সালের পর থেকে যখন পর পর স্থাপত্য মাথা তুলেছে, তাঁরা দেশবিদেশের হাঁ-মুখ দেখে পুলকিত হয়েছেন। কিন্তু মুখে বিনয়টি ধরে রেখে সেই বলেছেন, “আসলে আমরা বড্ড ছোট দেশ কিনা। তাই হয়তো লোকজনকে বোঝাতে সুবিধে হয়েছে।” ‘বড়’ হওয়ার বিড়ম্বনা চেপে বলা গিয়েছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু কোথাও একটা তীব্র সদিচ্ছারও দরকার হয়। ছোট বৃত্ত থেকে উত্তরণ ঘটাতে হয়। আকাশ ছোঁয়ার সিরিয়াস চেষ্টা করতে হয়। বিহ্বল প্রশ্ন করা গিয়েছে, কী করে করলেন এমন? কী করে হল? ম্যাজিকটা কী?
মোলায়েম হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়েই সিঙ্গাপুরের মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলেছেন, “ম্যাজিক-ট্যাজিক নেই। কী জানেন, প্রশাসককে নির্মোহ হতে হবে। তাঁকে নিজের রাজনৈতিক সত্তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তবেই তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের হতে পারেন। কিন্তু প্রশাসকের চেয়ারে বসা মাত্রই তিনি সক্কলের প্রশাসক। কথার কথা নয়। কাজেও করে দেখাতে হবে। তবেই লোকে আপনাকে ভরসা করবে। শ্রদ্ধা করবে। বুঝবে, আপনি তাদের ভালর জন্যই কাজটা করছেন!” ‘নির্মোহ প্রশাসক’, ‘নিজের রাজনৈতিক সত্তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা’ কথাগুলো ভারী চেনা। স্রেফ কথাগুলোই। |