মানুষটির বয়স কম কি বেশি, সে পুরুষ কি নারী, কিছুই বুঝিবার উপায় নাই। মস্তকটি করোটির ন্যায়, হাত দুইটি কানের উপর চাপা, চক্ষু বিস্ফারিত দুই গোলক। তাহার প্রলম্বিত হাঁ-মুখ হইতে যেন বিশ্বভেদী এক আর্তনাদ নির্গত হইতেছে। পশ্চাতের রক্ত-লাল সন্ধ্যাকাশে, নগরে প্রতিবিম্বিত সূর্যালোকে তাহার তীব্র আতঙ্কের প্রতিফলন। অথবা বিশ্ব চরাচরের অন্তর হইতেই যেন এক বিপুল চিৎকার উত্থিত হইয়া ওই মানুষটির মুখ দিয়া নির্গত হইতেছে। উজ্জ্বল লাল, ঘন নীল রঙে ছবি আঁকিয়াছিলেন নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড ম্যুন্খ। নাম দিয়াছিলেন ‘স্ক্রিম’। সরলতাই তাঁহার শিল্পের শক্তি। কেবল শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে নহে, বিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাই ‘স্ক্রিম’-এর পরিচিতি এত বেশি। সম্প্রতি ছবিটি যে ৬০০ কোটি টাকায় বিক্রয় হইয়াছে, যাহা নিলামে বিক্রীত ছবির নিরিখে সর্বোচ্চ, তাহা অপ্রত্যাশিত নহে। এত সমাদৃত শিল্পকর্ম সাধারণ মূল্যে বিক্রয় হইলে সকলে বিস্মিত হইত। ‘স্ক্রিম’ ছবির অপর তিনটি সংস্করণ নরওয়ের দুটি শিল্প সংগ্রহশালাতে রহিয়াছে, চতুর্থটি থাকিবে কোনও ধনীর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। অবশ্য যেগুলি জনসাধারণের জন্য প্রদর্শিত, নরওয়ের জাদুঘরে গিয়া সেই মৌলিক ছবিগুলি দেখিবার সৌভাগ্যও হইবে অতি অল্প লোকের। কিন্তু ছাপা সংস্করণেও বহু প্রজন্মকে আহত, বিচলিত করিতেছে ‘স্ক্রিম।’ ছবিটি হইতে উৎসারিত নীরব আর্তস্বর দর্শকের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাকে অভিভূত করে। এই চিৎকার যে অলৌকিক, তাহা স্পষ্ট করিতে শিল্পী ভয়ার্ত ওই ব্যক্তির পিছনে দুইটি ভদ্রলোক আঁকিয়াছেন, যাঁহারা ভদ্রোচিত টুপি-পোশাক পরিয়া সান্ধ্যভ্রমণে নিরত। জগৎব্যাপী ভয়ানক আর্তনাদ তাঁহারা শুনিতে পাইতেছেন না।
যখন এই ছবি আঁকিয়াছিলেন ম্যুন্খ, সেই ১৮৯৫ সালে বিশ্বায়নের প্রথম ঢেউ উঠিয়াছে, মুক্ত অর্থনীতির স্বর্ণযুগ। বিশ্বজোড়া বাণিজ্য, উন্নত প্রযুক্তি আর উদারতন্ত্র-গণতন্ত্র পরিচালিত প্রশাসন আধুনিক যুগের উন্মেষ করিয়াছে, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতা যেন মানবসমাজের করায়ত্ত বলিয়া মনে হইতেছে। আধুনিক যুগের সংকট-সংকেত বলিয়া যেগুলি চিহ্নিত, সেই বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা, দুই বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার সংগ্রাম, সন্ত্রাসবাদের উত্থান, সবই তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। সেই সময়ে নরওয়ের এক সূর্যাস্ত শিল্পীর চিত্তে কী করিয়া সেই অসহনীয় আতঙ্কের উদ্রেক করিয়াছিল, আধুনিক যুগের বিশ্বে যাহা দেশে দেশে মানুষের অন্তরে প্রতিধ্বনি তুলিবে? তাহা লইয়া অনেক জল্পনা রহিয়াছে। কেহ বলেন, অসলো শহরের ওই রাস্তায় রহিয়াছে একটি কসাইখানা এবং একটি মানসিক হাসপাতাল। শিল্পীর বোন অবসাদ রোগগ্রস্ত হইয়া তখন সেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মহৎ শিল্পের পশ্চাতে এমন কোনও নির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধান হয়তো বাতুলতা। তবু মনে না করিয়া উপায় নাই, সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করিয়াছে, ২০৩০ সালে মানসিক রোগ হইবে বিশ্বের বৃহত্তম অসুখ। উত্তর-আধুনিক যুগে ওই জাতি-লিঙ্গচিহ্নহীন ত্রাস-কবলিত মানুষটি যেন আমাদের আরও বিশ্বস্ত প্রতীক হইয়া উঠিয়াছে। |