যা ভাবা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই হল। অথৈ জলে চলে গেল জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি)।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই, নরেন্দ্র মোদী, জয়ললিতা, নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়করা কোমর বেঁধে বিরোধিতা করলেন কেন্দ্রীয় সরকারের। পিছিয়ে রইলেন না উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব বা জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার মতো সরকারের সমর্থক বা শরিক দলের মুখ্যমন্ত্রীরাও। অখিলেশ নিজে অবশ্য আজ বৈঠকে আসেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। সকলেরই বক্তব্যের মূল নির্যাস, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র কোনও ভাবেই নিজের সীমানা অতিক্রম করে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নবীন, নীতীশ কুমাররা এনসিটিসি-র ক্ষমতা নিয়ে আপত্তি তোলার পাশাপাশি
কিছু কিছু বিষয়ে সংশোধনের পরামর্শও দিয়েছেন। জয়ললিতা দাবি তুলেছেন, গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে একটি
উপ-কমিটি তৈরি করা হোক। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, জয়ললিতার নেতৃত্বেই এই কমিটি করা হোক। কিন্তু এনসিটিসি-র গোটা প্রস্তাবটিই কার্যত খারিজ করে দিয়েছেন মমতা। তাঁর দাবি, এনসিটিসি-র গঠন নিয়ে যে সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হোক। কারণ এক তরফা ভাবে কেন্দ্র এই ধরনের সংস্থা তৈরি করতে চাইলেও রাজ্যগুলির আপত্তি থাকলে তা বাস্তবায়িত করতে পারবে না। ঠিক একই দাবি তুলেছেন নরেন্দ্র মোদীও। মুখ্যমন্ত্রীদের উপ-কমিটি তৈরির প্রস্তাব নিয়ে মমতা বলেন, “আমরা যখন এনসিটিসি-ই চাইছি না, তখন এই ধরনের কমিটির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?” |
বিরোধী ও ইউপিএ-র সমর্থক দলের পাশাপাশি প্রধান শরিক দলের নেত্রীই ঘোর বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় এনসিটিসি নিয়ে এগোনোর চেষ্টা রাজনৈতিক ভাবেও লাভজনক নয় বলেই মনে করছে মনমোহন-সরকার। সারা দিনের বৈঠকের শেষে তাই দৃশ্যতই অসহায় দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে। এনসিসিটি ছিল তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। আজকের বৈঠকের পরে তিনি কোন পথে এগোবেন, ফের বৈঠক ডাকা হবে কি না, বৈঠক হলে তা কবে হবে, কোনও প্রশ্নেরই জবাব ছিল না তাঁর কাছে। কবে থেকে এনসিটিসি কাজ শুরু করতে পারবে? চিদম্বরমের জবাব, “এখনও তো এনসিটিসি-র ডিরেক্টরই নিয়োগ হয়নি!” এনসিটিসি গঠন নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে যে সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল গত ১ মার্চ থেকে এনসিটিসি কাজ শুরু করবে। সেই নির্দেশিকার কী হবে? চিদম্বরম বলেন, “নির্দেশিকা যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। আরও একটা ১ মার্চ আসবে!” এমনকী মুখ্যমন্ত্রীদের উপ-কমিটি তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়েও কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। শুধু জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীদের সব পরামর্শই খতিয়ে দেখা হবে।
শুধু এনসিটিসি নয়, সামগ্রিক ভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মনোভাব নিয়েই আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে চিদম্বরমকে। নিজের লিখিত বিবৃতিতে এনসিটিসি নিয়ে আপত্তি তোলার পাশাপাশি মমতা কড়া ভাষায় জানান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে ‘আমার পুলিশ, তোমার পুলিশ’-এর বিভাজন করার চেষ্টা হচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, কেন্দ্রের পুলিশ বেশি দক্ষ, রাজ্যের পুলিশের দক্ষতা কম। জয়ললিতাও এ বিষয়ে মমতাকে সমর্থন জানিয়েছেন। এনসিটিসি নিয়ে রাজ্যের আমলাদের সঙ্গে কেন্দ্রের বৈঠকে স্বরাষ্ট্রসচিব রাজ কুমার সিংহ মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্যের আমলাদের মুখ্যমন্ত্রীদের স্টেনোগ্রাফারের ভূমিকায় আটকে থাকা উচিত নয়। রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের এই মনোভাবের নিন্দা করেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্র এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যাতে রাজ্যগুলির মধ্যে
অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। দু’পক্ষের বোঝাপড়াটাই সন্ত্রাস দমনের সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে। মমতার যুক্তি, এনসিটিসি-র মতো চমক তৈরির রাস্তায় না গিয়ে কেন্দ্রের উচিত পুলিশি ব্যবস্থায় যে সব ফাঁক রয়েছে, আগে সে দিকে নজর দেওয়া। পুলিশ বাহিনী মজবুত করতে, গোয়েন্দা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও দুর্গম এলাকায় পরিকাঠামো গড়তে রাজ্যকে আরও বেশি অর্থসাহায্য করা হোক। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের জন্য বিশেষ বরাদ্দেরও দাবি তুলেছেন তিনি।
চিদম্বরমের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীরাও। মোটের উপর তাঁরা এনসিটি-কে সমর্থন করলেও তার কয়েকটি দিক নিয়ে আপত্তি জানাতে ভোলেননি। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ যুক্তি দিয়েছেন, যতটা সম্ভব রাজ্য পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই অভিযান চালানো উচিত। মুখ্যমন্ত্রীদের আপত্তি মূলত দু’টি জায়গায়, যা বুঝেছেন চিদম্বরম নিজেও। প্রথম, কেন এনসিটিসি-কে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) অধীনে রাখা হল? নবীন পট্টনায়করা যেমন যুক্তি দিয়েছেন, এনসিটিসি-কে আইবি-র অধীনে রেখে যত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, কোনও দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর তত ক্ষমতা নেই। ওমর আবদুল্লা তো একে আফস্পা-র সঙ্গে তুলনা করতেও ছাড়েননি! দ্বিতীয়, রাজ্য পুলিশকে এড়িয়ে গ্রেফতার বা তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা এনসিটিসি-কে দেওয়ার প্রয়োজন কোথায়? মমতা যেমন জানিয়েছেন, এক মাত্র বিরাট দুর্যোগ বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেই কেন্দ্র এই ধরনের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রীদের ঝাঁঝালো আক্রমণের মুখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনাতেও এনসিটিসি-কে আইবি-র অধীনে রাখার প্রস্তাব ছিল না। পরবর্তী কালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। চিদম্বরমের বক্তব্যেই স্পষ্ট, মনমোহন-সরকারের মধ্যেও এনসিটিসি নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, ২০০১ সালে এনডিএ-সরকারের আমলে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠীর সুপারিশ মেনেই এনসিটিসি-কে আইবি-র অধীনে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এই যুক্তিতেও অবশ্য লাভ হয়নি। বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, সন্ত্রাস দমন হল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ দায়িত্ব। চিদম্বরম যুক্তি দেন, সন্ত্রাসবাদীরা কোনও রাজ্য বা দেশের সীমানা মেনে কাজ করে না। দেশের সন্ত্রাস প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যে ফাঁক রয়েছে, তা কোনও সাধারণ পুলিশ বাহিনী দিয়ে পূরণ হবে না। তার জন্য এনসিটিসি বা এর মতো সংস্থারই প্রয়োজন। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই কাজ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের অবস্থানেই অনড় থেকেছেন। বৈঠক শেষে মোদী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “এটাকে কোনও ‘ইগো’র বিষয় হিসেবে না দেখে কেন্দ্রের অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার করা উচিত।” |