সময়ের ঠিক আগে একটি লোক দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে, ঠিক সময়ের ঠিক ঘণ্টা দিচ্ছে আবার টুক করে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। আর বাইরে বসে অন্য জন প্রতি সেকেন্ডে একটা ড্রামে হাতুড়ি পিটছে।
এক বর্ণও মিথ্যে নয়। এ সবই একটা ঘড়ির মধ্যে। ঘড়িটার উচ্চতা? বড়জোর সাড়ে তিন ফুট। চওড়া দেড় ফুট মতো। চার্চের আদলে তৈরি মাথার উপর ঘরে বসে দু’জন লোক অনবরত সময়ের সঙ্গের তাল রেখে পাল্লা দিয়ে চলেছে। উনিশ শতকে তৈরি এই ঘড়িটি এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতে দারুণ ভাবে সচল এবং সক্রিয়। আর এরই টানে মানুষ ছুটে আসেন হায়দরাবাদে।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি কুক অ্যান্ড কেলভি-র তৈরি এই দর্শনীয় ঘড়িটি রয়েছে হায়দরাবাদের সালারজং মিউজিয়ামে। হায়দরাবাদের নিজাম থ্রি ওরফে নবাব ইউসুফ আলি খান ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঘড়িটি সংগ্রহ করেন। ঘড়িটির ঠিক মূল্যের হদিস পাওয়া যায় না। তবে তখনকার দিনের পাঁচশো টাকার মধ্যেই কেনা। |
ঘড়িটিতে তিনশো পঞ্চাশটি পার্টস রয়েছে। যন্ত্রাংশগুলি ইংল্যান্ডে তৈরি হলেও একত্রিত হয়ে রূপ পেয়েছিল কলকাতায়। তাই আশ্চর্য এই ঘড়ির সঙ্গে কলকাতার এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েই গিয়েছে।
ঘড়িটির নাম মিউজিক্যাল ক্লক। ঘড়িটিতে একটি বড় ডায়াল রয়েছে। নীচে রয়েছে আরও দু’টি ছোট ছোট ডায়াল। একটিতে দিন, অন্যটিতে তারিখ এবং মাসের নির্ণয়। সপ্তাহে এক বার করে ঘড়িটিতে চাবি দিয়ে দম দিতে হয়। তাতেই ঘড়িটি সচল থাকে সপ্তাহভর।
সালারজং থ্রি ছিলেন খুবই শৌখিন। বিয়ে থা করেননি। ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল তাঁর দারুণ দারুণ সব সামগ্রী। চিনা, জাপানি, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য শিল্পকলা থেকে অসংখ্য দামি দামি মণিমুক্তো, পর্সেলিনের পাত্র, হাতির দাঁতের কাজ, মোঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ফল কাটা ছুরি, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মণিমুক্তো শোভিত ব্যক্তিগত ছোরা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি, টিপু সুলতানের হাতির দাঁতের চেয়ার, শিল্পী রবি ভর্মার আঁকা ছবি, ইতালীয় ভাস্কর্য ভেইলড রেবেকা-র পাঁচ ফুটের ওপর অসাধারণ মূর্তি সমস্তই ছিল তাঁর সংগ্রহে। ভেইলড রেবেকার সিক্ত বসনা মূর্তিটি একটি মাত্র মার্বেল পাথর খোদাই করে বানানো হয়েছে। বাইবেলে বর্ণিত এই বিখ্যাত নারী মূর্তিটির ভাস্কর্য চোখ চেয়ে দেখার মতো। ইতালির ভাস্কর জি বি বেনজনি এটি নির্মাণ করেন। আর রয়েছে একটি মাত্র পাথরে নির্মিত একটি আশ্চর্য মূর্তি সামনে যেটি পুরুষ আর আয়নায় যে পেছনের প্রতিকৃতি পড়ছে সেটি নারী। এটির শিল্পীর নাম জানা যায় না। তবে এটিও ইতালি থেকে সংগৃহীত। তিন ফুট চওড়া একটি তালপাতার পাখা রয়েছে, যা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
নিজাম থ্রি ইউসুফ আলি খান বেঁচেছিলেন মাত্র ষাট বছর (১৮৮৯-১৯৪৯)। তাঁর সেই সব অমূল্য সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে সালারজং মিউজিয়াম। গত বছরে এগারো লক্ষ দর্শনার্থী এই সংগ্রহালয় ঘুরে গিয়েছেন। দর্শনার্থী সংখ্যার বিচারে এর পরের স্থান কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের।
সত্যি বলতে, সালারজং মিউজিয়ামের মূল আকর্ষণ আজও এই অত্যাশ্চর্য সুন্দর ঘড়িটি। ঘণ্টা বাজানোর তিন মিনিট আগে দাড়িওয়ালা লোকটি দরজা খুলে বের হয়। সময় অনুযায়ী ঘণ্টা দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে ঢুকে যায়। আর সেকেন্ডের ঘণ্টা পিটে যে লোকটি, সে এক জন কামার। আশ্চর্য এই পুতুল দু’টিও ঘড়ির কল্যাণে অমরত্ব লাভ করেছে। আর দর্শকদের জন্য ঘড়ির সামনে কর্তৃপক্ষকে বিরাট বসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অনেক আগে না এলে সেখানে স্থান পাওয়া রীতিমত দুষ্কর! |