|
|
|
|
|
নির্জনে... নিজের সঙ্গে দেখা |
আকাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, জঙ্গল, পাখি, চিতাবাঘ, ভালুক, ট্রেকিং, বরফ...সব একই উঠোনে। আর সেই উঠোন আপনার, চটকপুর।
সেবক ব্রিজ ছাড়িয়ে তিস্তাকে ডান হাতে রেখে, হাজার সাতেক ফুট উঠেই পিকচার পোস্টকার্ড। জানালেন শোভন তরফদার |
আচ্ছা, এই যে বিরাট গরম, কী যেন বলে, তাপপ্রবাহ, তার মধ্যে কি চটকপুরের কথা মনে করা ভাল?
সে কী? বেড়াতে গিয়েছিলে, দারুণ লেগেছিল, লোককে জানাও, আহা, কী জায়গা...
ঠিক, কিন্তু দুঃখের দিনে সুখস্মৃতিও তেতো লাগে! কোটেশনটা কার যেন...যাক গে, এখন বাতাসে হলকা, অথচ চটকপুর, নাকি স্থানীয় বুলিতে ছত্তকপুর, যেটুকু মনে আছে, তার গায়ে বরফ, আকাশ শিশুর হাসির মত নীল, পাইনবন গম্ভীর।
উফ, এই সময়েই তো শুনব তার কথা... শুনতে শুনতে মজে গিয়ে একটুখানি কেঁপেও উঠব, শীতই করবে যেন, তারপর হুঁশ ফিরলে সরবত খাব, ঠাণ্ডা, চানঘরে গান করতে করতে আয়না দেখে নিজেকেই বলব, তুমি না, একটা... (হাসি)
ওকে, তা’লে বলি। আসলে এই ভ্রমণকাহিনিগুলো, সব গতে বাঁধা হয়। চারটে কাব্য কাব্য কথা, ওই যে বললাম, আকাশ শিশুর হাসির মত নীল, ও রকম, সঙ্গে দুটো পিকচার পোস্টকার্ড, শেষটায় একটু মন-খারাপ। চটকপুর সম্বন্ধেও তেমন কিছু একটা খাড়া করে ফেলাই যায়! কী নেই? আকাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, জঙ্গল, পাখি, চিতাবাঘ, ভালুক, ট্রেকিং, বরফ...
দাঁড়াও দাঁড়াও, ও ভাবে হয় না। একটু ম্যাপ-এ এসো। সেবক ব্রিজ ছাড়িয়ে গাড়িটা উঠছে। রাইট! তারপর?
ও বাব্বা, আদিকাণ্ড থেকে শুরু। তিস্তাকে ডান হাতে রেখে এগোনোর সময় বাঁ দিকে দোকান-টোকানে একটু খাওয়াদাওয়া। তারপর, এগোও, এগোও...উঠতে উঠতে সোজা মংপু ছাড়িয়ে জোড়থাং পর্যন্ত পৌঁছোও, তারপর বাঁ দিকে ঢুকে যাও... পাহাড়ি রাস্তা, এক দিকে গভীর খাদ, আর এক দিকে জঙ্গল...আরে, ওই যে জঙ্গল থেকে উড়ে গিয়ে খাদের দিকে নেমে গেল! কী ওটা?
মানে? |
|
আহহ, (মুচকি হাসি) একটু ড্রামা করলাম! বনমুরগি। আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, সেটা মনে পড়ে গেল। একটু নজর তীক্ষ্ন করলে জঙ্গলের মধ্যে, না চিতা-টিতা জানি না, কিন্তু হরিণ-টরিণ দেখতেই পারো! এ ভাবে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে, রাস্তাটা বেশ খারাপ, গাড়ির পিছনে বসলে একটু-আধটু ওয়াক আসাও বিচিত্র নয়, অক্সিজেন কমে যাচ্ছে তো, প্রায় হাজার সাতেক ফুট... বেশ খানিকটা যেতে যেতে একটা বাঁক ঘোরার পরেই সামনে তোরণ, চটকপুর ইকো-ভিলেজ-এ স্বাগত...
বাহহ, বেশ ট্যুরিস্ট গাইডের মতই হচ্ছে? কী আছে সেখানে?
পিকচার পোস্টকার্ড। দুটো পাশাপাশি কটেজ। তাতে দুটো করে ঘর। কটেজ থেকে বেরিয়ে সামনে একটা কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম। কেয়ারটেকারটি সদাহাস্যময়, বিনোদ রাই, রান্নাবান্না জিভে-জল আনা, লুচির সঙ্গে একটা তরকারি দেবে, আহহ...আর মুরগি-টুরগি তো ছেড়েই দাও! জাস্ট স্বর্গীয়! কটেজের পিছনে ধাপে ধাপে উঠেছে পাহাড়। কটেজের সামনে ধাপে ধাপে নেমেছে জঙ্গল। এখান থেকে ট্রেক করে টাইগার হিলও যাওয়া যায়। কটেজ থেকে বেরিয়ে ডান হাতে একটু এগোলে একটা ছোট গেট। সেটা খুললেই রাস্তা নেমে গিয়েছে, জঙ্গলের দিকে।
জঙ্গলটা কেমন?
সেথা উর্ধ্বে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম, যত আদিম মহাদ্রুম! (হাসি) মানিকবাবু, একটু বদলে নিলাম। কিন্তু, ঠিক ও রকমই! পাইন গাছগুলো কী লম্বা...
গাছের কাছে দাঁড়াও, দেখবে কত ছোট...
শক্তি চাটুজ্জে তো? চিনতে পেরেছি! গুড ওয়ান!
থ্যাঙ্কস, তুমিই খালি কোটেশন দেবে, আমি শুনব? (হাসি) যাক গে, তারপর? বলো।
জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দেখবে, গাছের গায়ে আঁচড়। ভাল্লুকের আঁচড়। দেখবে, একটা ডোবা গোছের। সেখানে জল খেতে আসে জীবজন্তুরা। খাড়া পাহাড় উঠে গিয়েছে, ঘন বন, তার মধ্যে সেই জল। জলের মাঝে বিশাল একটি পাথর, মাথায় উড়ছে নিশান, আর ছোট্ট একটা ফ্রেমে-বাঁধানো শিবঠাকুরের ছবি। রাত্রিবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে, অন্ধকার কী সুঠাম, আর অগুনতি তারা...মনে হবে, কত দিন স্রেফ সি এফ এল দেখেছি, অন্ধকারে চিৎ হয়ে শুইনি ছাদে...
আশ্চর্য! আর, ইয়ে, পাহাড়ের রেঞ্জ-টেঞ্জ... |
|
বলছি। ওই যে কটেজের পিছনে ধাপে ধাপে উঠেছে পাহাড়, সেখানে যাও। উঠতে থাক। উঠতে উঠতে এক সময় দেখবে আকাশটা চওড়া হচ্ছে, দৃষ্টি ছড়িয়ে যাচ্ছে, দূরে...এত দূরও হয় নাকি! পাহাড়ে একটা ওয়াচ টাওয়ার! সিঁড়ি আছে। উঠে পড়ো।
তার পর?
তার পর...! তার পর চটকপুরের এই চেনা গল্পটা, মানে গতে-বাঁধা গল্পটা ফুরোলো।
মানে? কী কী সাইট-সিয়িং-টিইং আছে বলোনি। কী করে ফিরব, ফেরার পথে কিছু...
উফ, সারাটা জীবন খালি প্যাকেজ, অ্যাঁ? এটা কিনলে ওটা, তার সঙ্গে সেটা... সে সব আছে। তার জন্যে গাইডবুকও আছে। আমি কেন? আর ফেরার কথা কী করে বলব? ফিরিনি তো...
প্লিজ, হেঁয়ালি নয়। লেখাটা কাগজে ছাপা হবে!
কী করব? সত্যিই আমি চটকপুরের ওই ওয়াচ টাওয়ার থেকে ফিরিনি। এখনও দাঁড়িয়ে আছি। ওখানেই। বাকরুদ্ধ।
এটা কিন্তু আবার কাব্য কাব্য হয়ে যাচ্ছে...
না, কাব্য নয়। তোমার বাঁ হাতে আকাশের গায়ে আঁকা আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর সামনে ঝাপসা আকাশ, আর গভীর খাদ। তাকালে মনে হবে, বুঝি বা আদিপাপের মতো গভীর। মনে হবে, সেটা চলে যাচ্ছে কোথায়, কে জানে, বোধহয় জন্মান্তরের দিকে... দেখলে বুকের ভেতরটা আচমকা খালি খালি লাগে। সেখান থেকে উঠে আসছে... কুয়াশা, না মেঘ! সেই চলন্ত আবছায়ার পুঞ্জ, নাকি চলমান অশরীরী... তোমার সমস্ত কথা কেড়ে নেবে, মুছে দেবে মাথার সমস্ত ছবি, সেই গভীর নির্জনে তোমার নিজের সঙ্গে দেখা হবে...মনে হবে, একটা চিৎকার করে উঠি আর সেই চিৎকারটা পাহাড়ে পাহাড়ে... নাহহ, আমাকে আর জিজ্ঞেস কোরো না, জানি না... |
|
|
|
|
|