|
|
|
|
আগে ‘না-পাওয়া’টা সমান হোক |
অতিরিক্ত কিচ্ছুটি নয়। শুধু নিজের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা ও পারিশ্রমিক পান মেয়েরা, এইটুকু হোক।
তার পর না হয় সবাই মিলে উপভোগ করব শ্রমদিবসের ছুটিটা। বললেন অন্বেষা দত্ত |
কাঠফাটা রোদ্দুর। কোথাও একটু ছায়া নেই। কোলের ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে রাস্তার এক ধারে। রোদ আড়াল করতে তার মাথায় একটা ছেঁড়া ছাতা। মা এ বার নিশ্চিন্তে মন দিয়েছেন কাজে। কিন্তু ছেলের যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, কেঁদে উঠে খোঁজে মাকে?
নাহ্। তা হওয়ার জো নেই। মা সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। তিনি তার পরিপাটি বন্দোবস্ত করে রেখেছেন আগেই। একরত্তি ছেলেটার মুখে নিজে হাতে তুলে দিয়েছেন আফিমের গুলি। কড়া ঘুমের দাওয়াই। না-হলে ঠিকাদার বড় গালিগালাজ করে। রোজের মজুরিও ঠিক মতো দিতে চায় না। কিছু বললেই বলে, কাজ করতে এসে ছেলে মানুষ করবে, না, পাথর ভাঙবে?
তাই মায়ের হাত বিরাম পায় না। এক হাতে হাতুড়ি আর এক হাতে পাথর। ছেলে ঘুম ভেঙে কাজে বাগড়া দিলে দিনের ১২০-১৫০ টাকাতেও পড়ে কোপ। রাজস্থানের কয়েকটি খনি আর পাথর ভাঙার জায়গা ঘুরে এই ভয়ানক ছবির কথা জানতে পেরেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা।
শ্রমিক-মায়ের বড় জ্বালা। বাড়িতে মাতাল স্বামীর পিটুনি। আর কাজের জায়গায় মালিকের খিটমিট। ঘুমপাড়ানি আফিম পরে হয়তো ওই ছেলেরই নেশার খোরাক হয়ে উঠবে, জেনেও মা নিরুপায়। পেট বড় দায়। জোগাড়ে বাবা কাজ করতে গিয়ে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে আজীবন পঙ্গু। বাবা যা-ও বা খেটেখুটে টাকা ঘরে আনতে পারত, মা তো তা পারে না। কারণ মা বাবার মতো শুধু শ্রমিকের বর্গে পড়েন না, মায়ের আলাদা ক্যাটেগরি মহিলা শ্রমিক। |
|
এই মা, এবং তাঁর মতো অনেক মেয়ে, যাঁরা ইটভাটা, পাথরভাঙা, বিড়ি বাঁধা, বা খনির মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাঁদের শ্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না, বা না পড়ার শামিল। অর্থাৎ ভাবখানা এমন, ওরা আছে, ঠিকই। কিন্তু ওদের দিয়ে তো আর তেমন ভারী কাজ করানো যয় না। যা করে, তা না-করার মতোই। মাসের মধ্যে অর্ধেক দিনই তো ওদের হাজার অসুবিধে। আর অন্তঃসত্ত্বা হলে তো কথাই নেই। ঝামেলার একশেষ। মালিক বা ঠিকাদারের বোঝা। ওদের পরিশ্রম খালি চোখে বোঝা যায় না বলে তার ন্যায্য মূল্য দিতেও তাই মালিক নারাজ।
মহিলা শ্রমিকদের প্রতি এই বৈষম্য আর ঔদাসীন্য অবশ্য অনেক সময়েই খাতায়-কলমে দেখা যায় না। সরকারি তরফে মহিলা-শ্রমিকদের পুরুষ-শ্রমিকের সমান বেতন দেওয়ার জন্য আইন (ইকোয়াল রেমিউনারেশন অ্যাক্ট) হয়েছে ১৯৭৬ সালেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন যে মেয়েরা, তাঁদের জন্য রয়েছে আরও একগুচ্ছ সুযোগসুবিধের ফিরিস্তি। যেমন, বিড়ি বাঁধেন যাঁরা, কর্মস্থলেই তাঁদের শিশুদের জন্য মোবাইল ক্রেশ রাখার বন্দোবস্ত করার কথা আইনে রয়েছে। এ আইন কার্যকর হলে তো আর আফিম খাইয়ে কচি শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় না। একই সঙ্গে এই সুবিধে পাওয়ার কথা নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলা শ্রমিকদেরও। দু’ক্ষেত্রেই আইন পাশ হয়েছে সেই ১৯৬৬ ও ’৭০ সালে।
খনি আইন (১৯৫২) অনুযায়ী, খনির নীচে মহিলাদের কাজ করানো নিষিদ্ধ। সকাল ৬টা থেকে সন্ধে ৭টা অবধি খনির ওপরে কাজ করতে পারেন। মহিলাদের জন্য থাকবে আলাদা বাথরুম।
বাস্তব ছবিটা কিন্তু আলাদা। প্রথমত খনির কাজে পুরুষদেরই বেশি প্রাধান্য। সেখানেও মহিলা শ্রমিকদের কাজটা ঠিক ‘চোখে পড়ার মতো’ নয়। কারণ মেয়েদের খনিতে কায়িক শ্রম ব্যয় করতে দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তিন দশকে খনির পুরুষ কর্মীদের বেতন বেড়েছে যথেষ্টই, কিন্তু মহিলা কর্মীদের সে ভাবে বাড়েনি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মহিলারা খনিতে যে ধরনের কাজ করেন সেগুলো হয় অদক্ষ বা কম দক্ষ কাজের মধ্যে পড়ে। কায়িক শ্রম খরচ না করলেই সেটা অদক্ষ কাজ?
সোনার খনিতে যে মেয়েটা খালি হাতে পারদ আর সায়ানাইড নিয়ে কাজ করে, তার কাজটা কোন দিক থেকে কায়িক শ্রম ব্যয়ের চেয়ে কম ঝুঁকির?
‘মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট’ (১৯৬১) অনুসারে সন্তান জন্মানো বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরের ৬ সপ্তাহ মহিলা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে বা অতিরিক্ত শ্রমসাপেক্ষ কাজ করানও আইনত নিষিদ্ধ। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিলেই এই আইনের সুবিধে পাওয়া উচিত মহিলাদের। মাইনে কাটার ওপরেও আছে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু খনির মহিলা শ্রমিকরা এ সব সুবিধে পান না প্রায়শই। অন্তঃসত্ত্বা হলেও প্রথম দিকে ছুটি মেলে না। সঙ্গে আছে কাজ হারানোর ভয়। অবসরের বয়স পর্যন্ত কাজও করতে পারে না অনেকে। অনেকে শ্বাসকষ্ট, সিলিকোসিস, যক্ষ্মা, লিউকিমিয়ার শিকার হন। মা হতে গিয়েও সমস্যা দেখা দেয়।
খনি একটা দৃষ্টান্তমাত্র। বেঙ্গালুরুর পিন্যা শিল্প এলাকার (টেক্সটাইল) মহিলা শ্রমিকদের কথা শুনুন। বস্ত্রশিল্পে বেঙ্গালুরুর অন্তত দেড় লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশিই মহিলা। ১০-১২ ঘণ্টা নাগাড়ে কাজ। একটা কারখানায় ৫০০ মহিলা কাজ করেন। কিন্তু বাথরুম মাত্র ৪-৫টি। কারখানায় নেই রেস্টরুম অথবা বাচ্চাদের ক্রেশ। মাসে ১৫০০-২০০০ টাকা মাইনে। সরকারের ঠিক করা মাইনের চেয়ে যা বেশ কম। বাৎসরিক ছুটি, বোনাস, অন্যান্য সুযোগসুবিধে— দুর্লভ। নির্মাণ সংস্থা বা রাস্তা তৈরির কাজের জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো মহিলা শ্রমিকদের জন্য আলাদা বাথরুম থাকেই না।
ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৪ কোটি মহিলা শ্রমিক কাজ করেন। (তথ্যসূত্র: পাটিয়ালার পাঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন রিসার্চ সেন্টার)। তাঁরা বলছেন, এ দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে সব মহিলা শ্রমিক কাজ করেন, তার কোনও সরকারি পরিসংখ্যান বা হিসেব পাওয়া যায় না। মালিকও আলাদা করে হিসেব রাখেন না নিজেদের স্বার্থে। সরকারি নথিভুক্তকরণ হয় না বলে মহিলাদের কাজ ‘ছদ্ম-কাজ’, এলেবেলে। কম টাকা দিয়ে, কোনও সুবিধে না দিয়ে ওঁদের দিব্যি খাটিয়ে নেওয়া যায়।
এই খেটে খাওয়া মহিলারা তাঁদের অধিকার বা আইনি সুবিধে নিজেরাই বা কতটুকু জানেন? স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংস্থা মাঝে মাঝে সরকারি উদ্যোগে নানা জায়গায় প্রচার চালিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করে। তাতে যে চেনা বঞ্চনার ছবিটা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, তা মোটেই নয়।
তিন দিন বাদেই মে দিবস। মে দিবসে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে এত সংগ্রাম-যুদ্ধের গল্প শুনে বড় হলাম, আর শ্রমিক শ্রেণির এই বিরাট অংশটা কী ভাবে রয়েছে, তা কখনও উঁকি দেবে না মনের কোণে? প্লিজ ভাববেন না, মে দিবস আরও একটা ‘মেয়ে দিবস’ হয়ে যাক এই বলে গলা ফাটাচ্ছি। পুরুষ শ্রমিকরাও যে তাঁদের হক থেকে বঞ্চিত সে কথা সবাই জানে। সত্যি। বাড়ির মানুষটা যে কম রোজগার করে, তার হকের টাকা পায় না, ঠিকাদারের অঙ্গুলিহেলনে তার রোজ চলে, এ কথা সে মেয়েটা খুব ভাল করেই জানে, যে চালাঘরটা সংসার নামে চালায়। কিন্তু মেয়ে-শ্রমিকদের অবস্থা আরও খারাপ। ওই যে, পুরুষ শ্রমিকের বেতন বাড়লেও মেয়েদের বাড়ে না, মেয়েদের কাজ ‘চোখে’ পড়ে না, মেয়েদের ভারী কাজটা ততটা ‘ভারী’ নয়। অথচ সারা দিন তালে তাল মিলিয়ে হাড়ভাঙা খাটনি ওই চোখে-না-পড়া শ্রমিকটারও যায়। আবার বাড়ি ফিরে সেই মেয়েটাকেই ফের ঘরের কাজকম্ম করতে হয়।
তাই বলছিলাম, আগে পুরুষ-শ্রমিক আর মেয়ে-শ্রমিকের সমস্যাগুলো সমান হোক। তখন একই হকের জন্য গলা ফাটানোর জোরটা আরও বাড়বে রোজ বাড়াও, ছুটি দাও, মেডিকেল পরিষেবা দাও। আগে মেয়ে-শ্রমিকদের গলা ফাটানোর সমান অধিকার আদায়ের জন্য অনেক গলা ফাটাতে হবে। পুরুষ শ্রমিকরা স্টেজে দাঁড়িয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। মহিলা-শ্রমিকদের আরও জোরে গলা ফাটানো দরকার, অথচ এখনও মেয়েরা স্টেজে ওঠার অনুমতি পায়নি। শ্রমিক বলেই ঠিক করে মানা হয় না, স্টেজে উঠবে কী করে?
নারী-শ্রমিকরা অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবি এত দিনেও ঠিক করে জানাতে পারেননি। আমরা যারা নিজেদের সচেতন নাগরিক বলে দাবি করি, তারা একটু আলাদা করে, একটু বিশেষ করে, এই মানুষগুলোর কথা ভাবি না হয় এই মে দিবসে। লেডিজ স্পেশাল ট্রেনের মতো আমাদের ‘আরও আরও আরও দাও’ বলে সুবিধে নিতে চাইছি না মোটেই। অতিরিক্ত কিচ্ছুটি নয়। শুধু নিজের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা ও পারিশ্রমিক পান মেয়েরা, এইটুকু হোক। দাবিতে সমান হওয়ার প্রথম সাধটা পুরুক। তার পর না হয় সবাই মিলে উপভোগ করব শ্রম-দিবসের ছুটিটা। |
|
|
|
|
|