|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
নষ্টনীড়েও অটুট নীড় |
অটুট রবীন্দ্রনাথও। মঞ্চে ও পর্দায় একই সঙ্গে নাটকের ‘সিনে-প্লে’। লিখছেন বিপ্লবকুমার ঘোষ। |
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’। নতুন আঙ্গিকে যা এই শহরে বেশ অভিনবত্বের দাবি রাখে। শ্রোতাদের কৌতূহল ছিল অন্য কারণে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথের লেখা এই গল্পটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় ১৯৬৪ সালে নির্মাণ করেছিলেন ‘চারুলতা’। সাতচল্লিশ বছর পরে সেই গল্প নিয়ে এক অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন রাখলেন গৌতম হালদার (চিত্র পরিচালক)। সিনেমা ও থিয়েটারের যুগ্ম ফসল বা বলা যায় ‘সিনে-প্লে’। ভারতের মঞ্চে সম্ভবত এই প্রথম মঞ্চে ও পর্দায় একই সঙ্গে অভিনয়। এই শহরে তো বেশ চমকই। চমক অন্য কারণেও। “আমাদের মনে হয়েছে সময়ের গরজেই মানুষ বারবার ধ্রুপদী শিল্পের কাছে ফিরে আসে। পরিবর্তিত সময়ের নতুন মন, নতুন চোখে তাকে নানা মাত্রায় আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে নয়।” এমনই দাবি পরিচালক গৌতম হালদারের। ইতিমধ্যেই এই নাটক এক নতুন প্রাণের মাত্রা যোগ করেছে নাট্যমোদি দর্শকদের কাছে। ভিড়ের বহরে মনে পড়ে যায় অতীতের ফেলে আসা থিয়েটার ঘেরা সেই সব উন্মাদনার কথা। দক্ষিণ কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে এমনই এক সন্ধ্যায় মনে হচ্ছিল, কলকাতা আছে কলকাতাতেই।
বলতেই হচ্ছে ‘নষ্টনীড়’-এ সিনেমা ও থিয়েটারের এমন মিশেলের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে হয়েছে পরিচালককে। যার প্রথম প্রেরণা উদয়শঙ্কর। মহাজাতি সদনে উদয়শঙ্করের ‘শঙ্করস্কোপ’-এ পর্দার দু’ পাশে দুটো সিঁড়ি ছিল। পর্দায় আকাশের নীচে কুশীলবরা একই মেকআপ-কস্টিউমে মঞ্চে এসে যখন নাচছিল সেই রূপালি পর্দা থেকে তাদের চাক্ষুস, জীবন্ত, নাগালের মধ্যে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকরাও। বহু দিন পরে তারই প্রতিফলন। যেন এই নাটকে সিনেমা এবং থিয়েটার পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা পড়ে অজানা আরও এক দিক। দর্শকের মন যেখানে মঞ্চের সীমানা পার হয়ে যেতে চায়, ক্লোজ আপ-এ চরিত্রের একান্ত অভিব্যক্তি দেখতে চায়। অথবা চরিত্রের অবচেতন কিংবা একই সঙ্গে দুই সত্ত্বা, তখন মঞ্চ থেকে তার চোখ মুক্তি পাবে পর্দায়। সুতরাং প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই প্রযোজনায় যদি তৃতীয় কোনও মাত্রা যোগ করে আমাদেরই অনুভবে, তা কম কি?
নাটকে গতি বাড়িয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের চারুলতার অমল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সাতচল্লিশ বছর পরেও তিনি এই প্রযোজনায় হয়ে উঠেছেন সূত্রধর। অমল-ভূপতি-চারুলতার সংসারে। যেখানে একা চারু হয়ে ওঠে অসংখ্য চারুর প্রতিবাদ-প্রতিধ্বনি। নারীর আত্ম আবিষ্কার, স্বনির্ভরতা, আত্মসম্মান। |
|
উনিশ শতকের শেষোর্ধে এলিট, রক্ষণশীল দেশপ্রেমী ভূপতি ইংরেজি ভাষায় রাজনীতির কথা লিখেছে। সেই বাড়িরই অন্দরমহলে তাঁর স্ত্রী চারুলতা লিখেছে প্রবন্ধ ‘আমার গ্রাম’। পরিচালকের নিপুণ হাতে বাস্তবের স্পর্শে মঞ্চে প্রতিফলিত হয় চারুর সহজ প্রেম, পরিণত হওয়া এবং প্রতিবাদের ঝড় তোলা।
এই প্রযোজনা থেকে পরিস্ফুট হয়েছে আরও এক দিক। যেখানে মনে হতে পারে নষ্টনীড় ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন, ‘যে সময়ে স্বামী স্ত্রী প্রেমোন্মেষের প্রথম অরুণলোকে পরস্পরের কাছে অপরূপ মহিমায় চিরনতুন বলিয়া প্রতিভাত হয়, দাম্পত্যের সেই স্বর্ণপ্রভামন্ডিত প্রত্যুষকাল অচেতন অবস্থায় কখন অতীত হইয়া গেল কেহ জানিতে পারিল না। নতুনত্বের স্বাদ না পাইয়াই উভয়ে উভয়ের কাছে পুরাতন পরিচিত অভ্যস্ত হইয়া গেল।’ ‘নীড়’ মানে নিছক বাস করার পরিকাঠামো নয়। তবে তা নষ্ট হবার প্রশ্ন কোথায়। নাটকে সেই সত্যটাকেই তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকের গতি বাড়িয়েছেন অমল শুভ্রজিৎ দত্ত। মানানসই চেহারায় অভিনয়ের ছুটন্ত ঘোড়া। নির্দেশক নিঙড়ে নিয়েছেন অমলের অভিনয় নির্যাস। একই কথা উমাপদ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও। বিভিন্ন সময়ের মানসিক বিপর্যয়ে তাঁর অবিচল থাকার দৃঢ়তা কী ভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয় তা গৌতম দেখিয়েছেন। চারু ঋতাভরী চক্রবর্তী চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। মন্দাকিনী চরিত্রে পাপিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজ পরিমল দাস, মতিলাল তপন দাশগুপ্ত সাবলীল। ‘রক্তকরবী’ নিয়ে মঞ্চে সার্থক এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন গৌতম হালদার। তিনি আবারও সসম্মানে যোজকের ‘নষ্টনীড়’কে এগিয়ে দিলেন সেই সিংহাসনে। |
|
|
|
|
|