|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
ক্যাঙারুর দেশে
জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেটে যায় অনেকটা সময়।
সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নদী পারাপার করছে লঞ্চ। অস্ট্রেলিয়া
বেড়ানোর এ বার শেষ পর্ব। লিখছেন দেবদূত ঘোষঠাকুর |
|
এক সময় মনে হচ্ছিল ঠিক দেখছি তো!
লঞ্চটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সেতুটা। হুবহু আমাদের হাওড়া ব্রিজ! বেশ কিছুটা দূরের কোনও উঁচু বাড়ির ছাদে উঠলে হাওড়া ব্রিজকে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনই।
জায়গাটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে। ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯৪৩-এ কলকাতা ও হাওড়াকে জুড়ে দেওয়ার জন্য গঙ্গার উপরে তৈরি করেছিল ওই সেতু। অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ব্রিসবেনে ১৯৪০-এ তৈরি হয়েছে স্টোরি ব্রিজ, ব্রিসবেন নদীর উপরে। হাওড়া ব্রিজের দু’টি প্রান্তের মধ্যে দূরত্ব ১৫০০ ফুট। ব্রিসবেনের সেতুটির ক্ষেত্রে তা ৯২৪ ফুট। আর দু’টি সেতুই প্রযুক্তিবিদদের ভাষায় ক্যান্টিলিভার ব্রিজ। তাই দু’টির মধ্যে অদ্ভুত মিল।
আর ওই স্টোরি ব্রিজই ব্রিসবেনের জন্য তৈরি করে দিল ভালবাসা। ওই একটি ব্রিজই শুধু নয়, ব্রিসবেন নদীর উপরে নয় নয় করে রয়েছে ১৬টি ব্রিজ। এর মধ্যে একটি রয়েছে শুধু সাইকেল এবং পথচারীদের জন্য। ব্রিসবেন নদীর চেয়ে কলকাতার গঙ্গা অনেক বেশি প্রশস্ত। কলকাতায় গঙ্গাতীরের দু’পাশ সাজানোর কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। কিন্তু ব্রিসবেন শহরটাই গড়ে উঠেছে নদীর দুই দিককে কেন্দ্র করে। শহরের বেশ কয়েকটি হোটেল, বিনোদন পার্ক গড়ে উঠেছে নদীর দুই দিকে। |
|
আমাদের হোটেলটা ছিল একেবারে নদী-লাগোয়া। জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেটে যায় অনেকটা সময়। সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নদী পারাপার করছে লঞ্চ। প্রতিটি লঞ্চই যাত্রীভর্তি। নদীর উপরে ১৬টি সেতু। গাড়িতে নদী পেরিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। তবু লঞ্চে যাত্রীর অভাব হয় না কেন?
নদীর ধারে বাঁধানো রাস্তায় ভোরে সাইকেল চালাচ্ছিলেন আইনজীবী মধ্যবয়সী এডওয়ার্ড। বললেন, “আমার বাড়িতে দু’দুটো গাড়ি আছে। আমাকে রোজ যেতে হয় নদীর ও পাশে। লঞ্চেই যাতায়াত করি। আসলে যত কম গাড়ি চড়ব তেল তত বাঁচবে। পরিবেশ দূষণ কমবে। ছুটির দিনে বা খুব দূরে গেলে গাড়ি ব্যবহার করি।”
শহরটা যে কতটা পরিবেশপ্রেমী তা বোঝা গেল এক রবিবার। সেই রবিবার গাব্বায় ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদেশীয় খেলা ছিল। তার দু’দিন আগে শহর জুড়ে প্রশাসনের তরফে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘রবিবারের খেলা আমরা সবাই দেখব। কিন্তু দয়া করে নিজের গাড়ি আনবেন না। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ব্যবহার করুন।’ দূর থেকে যাঁরা খেলা দেখতে এসেছিলেন তাঁরা গাড়ি রেখেছিলেন শহর থেকে কিছুটা দূরে। সেখান থেকে এসেছেন বাসে চেপেই। আর শহরের প্রচুর মানুষকে দেখলাম সাইকেল চালিয়েই চলে এসেছেন। এখানকার সব শহরের আকাশের রঙ তাই বড় বেশি নীল। |
|
সাগর-ঘেঁষা পথটি ধরে মসৃণ রাস্তা দিয়ে হু হু করে চলেছে গাড়ি। গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। চড়াই-উৎরাই বেয়ে চলেছি আমরা। তিন দিকে সবুজ পাহাড়। এক দিকে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। প্রশান্ত মহাসাগর। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রাস্তা। গন্তব্য নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সপ্তাহান্ত কাটানোর সেরা জায়গা উলংগং। প্রশান্ত মহাসাগরের এক সৈকত-শহর।
শহরটা ছোট। কিন্তু সমুদ্রতট বহু দূর বিস্তৃত। কিন্তু ওই সমুদ্রতট থেকেও আকর্ষণীয় মনে হল উলংগং যাওয়া-আসার রাস্তাটা। আর ওই রাস্তার অন্তত ছয় কিলোমিটার গিয়েছে সমুদ্রের উপর দিয়ে। গোটা পথের ওই অঞ্চলটাই সব থেকে আকর্ষণীয়। কিন্তু সেতু গড়ার প্রয়োজন হল কেন? গাড়ির চালক বলছিলেন, “এই অঞ্চলের পাহাড়টা ভঙ্গুর। সব সময়েই খসে পড়ছে পাথর। এক বার করে সারাই হচ্ছে, ফের ভেঙে যাচ্ছে। তাই সরাসরি সমুদ্রের উপর দিয়েই তৈরি হয়েছে সেতু।”
বাকি যাত্রাটাও কম আকর্ষণীয় নয়। খাড়াই-উৎরাই বেয়ে কখনও গাড়িটা চলে আসছে সমুদ্রের কাছাকাছি। কখনও উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের উপরে। সিডনির শহরতলি এই সব এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ ধাঁধানো। মাঝে মাঝে যে-সব উপনগরী পড়ছে সেগুলি প্রধানত দুধ, চিজ, মাখন, মাংস, ডিম আর ফল-সবজির হোল সেল মার্কেট। শহর সিডনির অধিকাংশ হোটেল রেস্তোরাঁর কাঁচামালই সরবরাহ হয় এই ‘সবুজ উপত্যকার’ ডেয়ারি ও পোলট্রি ফার্মগুলি থেকে।
সেতুর যে অংশটা সমুদ্রের সব থেকে উঁচুতে সেখানে দেখা গেল রেলিংয়ের সরু গ্রিলে আটকানো সার সার তালা। আমাদের গাইড ডগলাস বললেন, “এগুলি ‘লাভার্স লক’। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখানে এসে এক সঙ্গে একটি তালা ওই গ্রিলে লাগিয়ে চাবিটা ফেলে দেন সমুদ্রে। অর্থাৎ এ ভাবেই তাঁদের ভালবাসা তাঁরা তালাবন্ধ করে রাখলেন। সেই চাবি কেউ পাবে না। আর ভালবাসার বন্ধনও কাটবে না কখনও।”
কিন্তু শতকরা ১০০ ভাগ শিক্ষিত এই দেশের যুবক-যুবতীদের এমন কুসংস্কার কেন? ডগলাসের ব্যাখ্যা, “সংস্কার নয়। বলতে পার আবেগ। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরের প্রতি ভালবাসার প্রমাণ দিতে ছুটে আসেন এখানে। নিজেদের ভালবাসার স্বাক্ষর রেখে যান।”
আর এই পথে দুপুরের খাবারটাও বেশ উপভোগ করা গেল। উপত্যকা জুড়ে যে সব ফার্ম রয়েছে তাদের কয়েকটি রাস্তার ধারে রেস্তোরাঁ খুলে ভাল ব্যবসা করছে। যারা টাটকা ফল, ফলের রস, সবুজ সবজি, চিজ, ডিম, মুরগির মাংস আর আইসক্রিমের ভক্ত তাদের জন্য ঢালাও ব্যবস্থা রয়েছে ওই সব হোটেলে। নিজেদের ডেয়ারিতে তৈরি নানা ধরনের চিজ সাজানো রয়েছে। আর রয়েছে নানা ধরনের ফল। কলা, আম, প্যাসন ফ্রুট, পেঁপে, আঙুর, পিচ, আপেল থরে থরে সাজানো। ওখানে বসে খাওয়া যায় বা রাস্তায় খাওয়ার জন্য নিয়েও নেওয়া যায়। এখানকার গ্রিন স্যালাড গোটা অস্ট্রেলিয়ায় সমাদৃত। আর ডিমের হরেক রকম পদ রয়েছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব বুঝতে পারছিলাম না।
ক্যাথলিন এই রোস্তারাঁর ম্যানেজার। আমাদের দোলাচল দেখে এগিয়ে এলেন। অতএব ক্যাথলিনের উপরেই ছেড়ে দেওয়া গেল পছন্দের ভার। আমের সরবত, হাফ বাটি গ্রিন স্যালাড, একটা ডাবল ডিমের অমলেট (ভিতরে চিজের কুচি) আর মিক্সড ফ্রুট আইসক্রিম দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম।
সেই স্বাদটা মুখে লেগে আছে এখনও।
|
|
|
|
|
|