কেরল, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র পেরেছে। কিন্তু পারছে না পশ্চিমবঙ্গ। আর তাই এ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রসূতিকে নিজেদের টাকা খরচ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। কিনতে হচ্ছে ওষুধ। এমনকী তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে আসা বা প্রসবের পরে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিশেষ অ্যাম্বুল্যান্স (‘নিশ্চয় যান’) থাকার কথা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটাও মিলছে না।
প্রসবের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং প্রসবের সময়ে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কমাতে ২০০৫ সালে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’ চালু করেছিল কেন্দ্র। এই প্রকল্পে হাসপাতালে নিখরচায় প্রসবের পাশাপাশি কোনও অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলা যিনি নিয়ম মেনে চেক-আপ করাচ্ছেন, প্রসবের আগে তাঁর ৫০০ টাকা এবং প্রসবের এক সপ্তাহের মধ্যে আরও ১০০ টাকা প্রাপ্য। এরই সঙ্গে প্রসব সংক্রান্ত যাবতীয় খরচও সরকারের বহন করার কথা। কিন্তু এ রাজ্যে নগদ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং হাসপাতালের থাকা-খাওয়া বাদ দিলে বহু ক্ষেত্রেই প্রসব সংক্রান্ত বেশ কিছু খরচ করতে হয় প্রসূতির পরিবারকেই।
স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, এর পিছনে চিকিৎসকদের একাংশের মনোভাব যেমন দায়ী, তেমনই দায়ী পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ব্যর্থতা। সেটা কী রকম? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বললেন, “হাসপাতালের দোকানে যে সব ওষুধ নেই, বহু ক্ষেত্রেই সেই সব ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকেরা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওষুধ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মীর গাফিলতিতে তা প্রসূতির কাছে পৌঁছচ্ছে না।” এর পাশাপাশি, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করানোর সময়ও প্রসূতিদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ বেশির ভাগ হাসপাতালেই ওই যন্ত্র খারাপ থাকে। পিপিপি প্রকল্প চালু না হওয়ায় বাইরে থেকে বেশি খরচে প্রসূতিদের এই পরীক্ষা করাতে হয়।
সরকারি হাসপাতালে প্রসবের ক্ষেত্রে চিকিৎসা বাবদ একটি টাকাও যাতে প্রসূতি বা তাঁর পরিবারের কাছ থেকে খরচ না হয়, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। তবে নানা ক্ষেত্রে প্রসূতিদের টাকা খরচ হওয়ায় সেই নির্দেশও যে এক অর্থে অমান্য করা হচ্ছে, সে কথা মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। প্রসূতি চিকিৎসার হাল এ রকম কেন, তা জানতে চেয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্র।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, সমস্যার সমাধানে নতুন ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁরা। তিনি বলেন, “হাসপাতালের পাশে কোনও ওষুধের দোকানের সঙ্গে চুক্তি হবে স্বাস্থ্য দফতরের। বাইরের ওষুধ কিনতে হলে প্রসূতির বাড়ির লোকেরা হাসপাতালের স্লিপ নিয়ে সেখানে যাবেন। দোকান থেকে তাঁদের বিনা পয়সায় ওষুধ দেওয়া হবে। ওষুধের দোকান বিল পাঠাবে হাসপাতালকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই বিল মেটাবেন। স্বাস্থ্য দফতরের পরিভাষায় এই ব্যবস্থার নাম ‘ইমার্জেন্সি লোকাল পারচেজ’। কিন্তু সরকারের ঘর থেকে টাকা আসতে বছর ঘুরে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক ওষুধের দোকানই এই প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না বলে দফতর সূত্রের খবর।
‘নিশ্চয় যান’ প্রকল্পের জন্য রাজ্যকে ২০০৯ সালে ৪৪ কোটি টাকা দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত তার মধ্যে মাত্র ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে স্বাস্থ্য কর্তারা জানান, তাঁদের কাছেও বিভিন্ন জেলা থেকে ওই বিশেষ অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ার অভিযোগ আসছে। তাঁদের বক্তব্য, একটি হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন বহু প্রসূতির ছুটি হয়। অনেকেই বহু দূর থেকে আসেন। এক জনকে পৌঁছে আর এক জনকে বাড়ি নিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, “প্রত্যেকের আলাদা অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করা অসম্ভব। প্রসূতির পরিবার বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করলে টাকা দিতে রাজি আছি। সমস্যা হল, সরকারের কাছ থেকে টাকা পেতে দেরি হবে, সেই আশঙ্কায় বেশির ভাগ অ্যাম্বুল্যান্স চালকই এতে রাজি হচ্ছেন না।”
হাসপাতালে না-থাকা ওষুধ লেখার যে প্রবণতা চিকিৎসকদের মধ্যে দেখা যায়, তা অনেকটাই বন্ধ করতে পেরেছে কেরল ও তামিলনাড়ু। অ্যাম্বুল্যান্সের ক্ষেত্রেও নগদ টাকা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এ রাজ্য তা পারছে না কেন? স্বাস্থ্যকর্তাদের জবাব, দীর্ঘদিনের অনিয়ম রাতারাতি উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এর জন্য লাগাতার চেষ্টা দরকার। আর তাঁরা সেটাই করছেন। |