তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের একাংশের ‘কুৎসা’-র জবাব দিতে এ বার একটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র খোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবে থেকে এগুলি চালু হবে, সে সম্পর্কে অবশ্য বিস্তারিত কিছু জানাননি মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য সরকার বা শাসক দলের টিভি চ্যানেল চালানোর চেষ্টা অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আমলেও একই চেষ্টা হয়েছিল। এনডিএ-জমানায় তৎকালীন তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী অরুণ জেটলিকে এ বিষয়ে চিঠিও লিখেছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু কেন্দ্রের সম্মতি না মেলায় সিপিএমের তরফে অন্য বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা চ্যানেল তৈরি হয়। তাতে অবশ্য এনডিএ-সরকার আপত্তি করেনি। একই ভাবে কেরলেও সিপিএমের মালয়ালম চ্যানেল চালু হয়েছে। সরকারের তরফে পত্রিকা চালানোর ঘটনাও অবশ্য রাজ্যে নতুন নয়। এ রাজ্যে বেসরকারি মালিকানায় দৈনিক বসুমতী পত্রিকার জন্ম ১৯১৪ সালে। প্রায় ৬০ বছর পরে ১৯৭৪ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পত্রিকাটি অধিগ্রহণ করেন। সেই থেকে বসুমতী ছিল সরকারের ‘মুখপত্র’। বাম আমলে কলকাতা থেকে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে তা শিলিগুড়ি থেকে বের করা শুরু হয়। বসুমতী সংবাদপত্র পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০০২ সালে। তার পর থেকে শুধু প্রকাশনার কাজ করে চলেছে বসুমতী সাহিত্য মন্দির। তবে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের ‘পশ্চিমবঙ্গ’-র মতো মাসিক পত্রিকা সরকারি অর্থেই চলে আসছে।
আজ রাজ্য সরকারের জোড়া সংবাদমাধ্যম খোলার কথা জানিয়েছেন মমতা। সরকারি সূত্রের খবর, আপাতত ঠিক হয়েছে, টিভি চ্যানেলের নাম হবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’। সংবাদপত্রের নাম হতে পারে ‘মা-মাটি-মানুষ’। প্রসঙ্গত, তৃণমূল দলের একটি মুখপত্রের নামও ‘মা-মাটি-মানুষ’। এ দিন টাউন হলে সরকারি অফিসারদের (ডব্লিউবিসিএস-এগজিকিউটিভ) এক সভায় ওই ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের সরকার উন্নয়ন ও জনমুখী কাজ করে চলেছে। তা সত্ত্বেও অপপ্রচার হচ্ছে। কুৎসা বেশি হচ্ছে। সরকারের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমরা এত কাজ করছি। কিছু মিডিয়া তা দেখতে পাচ্ছে না। সাধারণ বিষয়কে বিতর্কিত করছে (নন-ইস্যুকে ইস্যু)। সেই জন্য সরকার একটি চ্যানেল খুলবে, সংবাদপত্র চালু করবে, যাতে সরকারের প্রচার আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছয়।” সরকারি কর্মীদের কোনও কুৎসায় কান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এরা বাংলার মা-কে অসম্মান করছে। তবে তিন-চার মাস পরে আর কিছুই পাবে না। আমরা সব গর্ত বুঝিয়ে এগিয়ে যাব। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে রাজা চলে বাজার, কুত্তা ভোকে হাজার!”
সামগ্রিক ভাবে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বরাবর সরব ছিল বামফ্রন্ট সরকার এবং সিপিএম। এখনও তারা সংবাদমাধ্যমকে ‘শ্রেণিশত্রু’ বলে মনে করে। রাজ্যে ক্ষমতা বদলের কয়েক মাস পর থেকে মমতাও সেই একই অভিযোগ করে চলেছেন। তিনি অবশ্য সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধেই সরব। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের একাংশ ‘অপপ্রচার ও কুৎসা’ করে চলেছে বলে অভিযোগ মমতার। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সরকারি গ্রন্থাগারে সংবাদপত্র রাখা নিয়ে ফরমান জারি করেছে তাঁর সরকার। এ বার, এক ধাপ এগিয়ে ‘এক বছরের মধ্যে ১০০% কাজ সেরে ফেলা’-র ‘সাফল্য’ তুলে ধরতে চ্যানেল ও সংবাদপত্র খোলার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক মমতার এই পরিকল্পনা পুরোপুরি খারিজ করে দিচ্ছে না। মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, রাজ্য সরকার সরাসরি নিজেই চ্যানেল চালাচ্ছে, এমন দৃষ্টান্ত বিশেষ নেই। তবে রাজ্য সরকারের কোনও সংস্থা বা দফতর চ্যানেল চালাতেই পারে। আবার বেসরকারি কোনও সংস্থার চ্যানেলে রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক মদত থাকলে তাতেও তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের আপত্তি তোলার কিছু নেই। এমন উদাহরণও ভুরিভুরি রয়েছে। অন্ধ্রে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি ‘সাক্ষী টিভি’ তৈরি করেছিলেন। তামিলনাড়ুতে করুণানিধি পরিবারের যেমন ‘সান টিভি’ রয়েছে, তেমনই জয়ললিতার মালিকানায় রয়েছে ‘জয়া টিভি’। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকার সময় কংগ্রেসের তরফে একটি টিভি চ্যানেল খোলার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু লাভজনক হবে না ভেবে তা থেকে পিছিয়ে আসা হয়। বিজেপির তরফেও ‘যুবা’ নামের একটি চ্যানেল খোলা হয়েছে। তবে এখনও তা শুধু ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই সম্প্রচার করা হয়।
তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, কোনও রাজ্য সরকার নিজেই সরাসরি দৈনিক পত্রিকা চালাচ্ছে, এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। পশ্চিমবঙ্গের তরফে আবেদন জানানো হলে তা খতিয়ে দেখতে হবে। রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র জানান, চ্যানেল তৈরির কাজ জোরকদমে এগিয়ে চলেছে। সল্টলেকের রূপকলা কেন্দ্রে তিনটি স্টুডিও নেওয়া হচ্ছে। এই চ্যানেলে সরকারি কাজের যাবতীয় তথ্য পরিবেশন করা ছাড়াও থাকবে শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান। রাজ্যের লক্ষ্য, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সম্প্রচার চালু করা। চ্যানেল চালুর পরে প্রকাশিত হবে বাংলা সংবাদপত্রটি। সেটি ছাপা হবে বসুমতী থেকে। রাজ্যের ওই মুখপাত্রের বক্তব্য, নতুন চ্যানেল তৈরির জন্য কেন্দ্রের থেকে যে সব অনুমোদন লাগে, তা জোগাড় করার জন্য তৎপরতা শুরু হয়েছে। উপগ্রহের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ‘ইসরো’ থেকে যে অনুমোদন লাগে, অনেক আগেই তার সম্মতি নেওয়া রয়েছে। সরকার নিজেই চ্যানেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় কর ছাড়ের ক্ষেত্রে নানা রকম সুবিধা পাওয়া যাবে।
রাজ্যের বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যখন কোষাগারের করুণ অবস্থা, তখন চ্যানেল-সংবাদপত্র চালানোর খরচ কোথা থেকে আসবে? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, চ্যানেল শুরু করাতে বেশ কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে। সরকারি কর্মী ছাড়াও চ্যানেলের কিছু পদে বাইরের লোকেদের ‘ভাতা’ দিয়ে নেওয়া হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর চ্যানেলের দায়িত্বে থাকলেও এ জন্য আলাদা করে তহবিল তৈরি করবে সরকার।
|
সাফল্য: দাবি ও পরিসংখ্যান |
• সোমবার তিনি বলেছিলেন, কাজের বিচারে তাঁর সরকার একশোয় একশো।
• বুধবার মন্ত্রী-সচিবদের বৈঠকে তাঁর দাবি ছিল, “নির্বাচনের আগে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তার ৯০% কাজ করে ফেলেছি।”
• আর শুক্রবার বসিরহাটে এক অনুষ্ঠানে
তাঁর ঘোষণা, “দশ মাসে দশ বছরের কাজ করেছি।” |
• প্রথম বর্ষপূর্তির মাসখানেক আগে সরকারের ‘সাফল্য’ নিয়ে এমন নানাবিধ ‘হিসেব’ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু গত ২৩ মার্চ বিধানসভায় তাঁর অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পেশ করা পূর্ণাঙ্গ বাজেটের তথ্য কিছুটা অন্য কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবর্ষের (২০১১-১২) বাজেট প্রস্তাবে পরিকল্পনাখাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। পরিমার্জিত হিসেব অনুযায়ী, বছর শেষে তার প্রায় ৩ হাজার কোটি (প্রায় ১৫%) খরচই করে উঠতে পারেনি রাজ্য। |
পরিকল্পনা ক্ষেত্র |
বাজেট প্রস্তাব |
পরিমার্জিত |
কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র, গ্রামোন্নয়ন |
৩৭৭৬.৪৩ |
৩৮৯২.৩১ |
সেচ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় |
১৯০২.৭৩ |
৮৪২.৫১ |
শক্তি |
৫১৯.৩৫ |
৫০৩.৪০ |
শিল্প ও খনিজ |
৮০৯.১৬ |
৬১৯.২৯ |
পরিবহণ |
২৩৭.৯৪ |
১০৫১.১৩ |
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ |
১৩৮.১৬ |
১১২.৬৫ |
শিক্ষা, তথ্য-সংস্কৃতি |
৩৫৫১.০১ |
৩০৫৪.২৩ |
স্বাস্থ্য, পরিবারকল্যাণ |
৮৭৫.৮৫ |
৬৬৬.১৩ |
পানীয় জল, নিকাশি, নগরোন্নয়ন |
৫০৬২.৮২ |
৩৯৮৯.২৩ |
তফসিলি, অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ |
৩৪৪.৩০ |
৩২২.২০ |
অন্যান্য |
২৭২৫.৯২ |
২৯৫৫.৬০ |
মোট |
২০৯৪৯.৬৭ |
১৮০০৮.৬৮ |
* সব অঙ্ক কোটি টাকায়
তথ্য: রঞ্জন সেনগুপ্ত |
|
|