দাদাগিরি: কোটলায় সৌরভ-রাজ
অত্যাশ্চর্য পুনর্জন্ম এ বার সেনানী সৌরভের
ভারতের রাজধানীর বুকে শনিবার মাঝরাতে গত কুড়ি বছরের বহু চর্চিত, আলোচনায় ক্ষতবিক্ষত ফের সেই প্রশ্নটা উঠে পড়ল। কে লেখেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্য?
স্বয়ং সৌরভ ঘনিষ্ঠদের বারবার জবাব দিয়েছেন, “কে আবার লিখবে? ওপরওয়ালা লেখে।” যখন বলা হয়, ওপরওয়ালা নিশ্চয়ই তাঁর সেরা চিত্রনাট্যকারকে দিয়ে আপনারটা লিখিয়েছেন। নইলে কাহিনীতে এত মোচড়, এত সাসপেন্স, এমন রুদ্ধশ্বাস নাটক আর আপাত অবাস্তব সব ব্যাপার নিয়মিত ভাবে ঘটতে থাকে কেন? তখন সৌরভ হেসে চুপ করে যান। শনিবার কোটলায় তাঁকে কেন্দ্র করে সেই অলৌকিক মেগাসিরিয়ালের আরও একটা রোমহর্ষক এপিসোড ছিল। যেখানে তিনি সব অঙ্ক আর বিজ্ঞান তছনছ করে দিয়ে ফের পরিত্যক্ত ছাইয়ের গুদাম থেকে উঠে এলেন। সেনাপতি হিসেবে পুনর্জন্ম দিয়েছিল আইপিএলে এ বারের ওয়াংখেড়ে। অপরিহার্য সেনানী হিসেবে নতুন জীবন দিল কোটলা। সেখানে হয়তো বা শেষ অবতরণে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে চলে গেলেন সৌরভ। ‘অলৌকিক’ নামধারী তাঁর মেগাসিরিয়ালে আজকের এপিসোড আরও রোমহষর্ক এই জন্য যে, এই পুনর্জন্ম বোলার হিসেবে।
প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচের যখন পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন, আরও একবার গুলিয়ে গেল পুণে হোম-এ জিতে উঠল না বাইরে? খেলা শুরুর আগে হর্ষ ভোগলেকে দেখলাম দৌড়তে দৌড়তে টিভি বক্সে ঢুকছেন। বলছেন, এখুনি একটা তথ্য পেলাম। আজ পর্যন্ত আইপিএলে দিল্লিতে হওয়া কোনও ম্যাচ এত টাকার ব্যবসা করেনি। গত কালই লিখেছি ভরপুর এই বক্স অফিসে প্রধান রংমশাল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শুধু চিত্তরঞ্জন পার্ক নয় দিল্লি শহরের নানা অংশ থেকে বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে প্রচুর মানুষ কোটলায় সম্ভবত তাঁর শেষ পদার্পণ দেখার জন্য ভিড় করেছিলেন। সৌরভ যেন গলা অবধি তাঁদের মন ভরিয়ে দিলেন পরিচিত তাঁর সেই প্যাশন আর পারফরম্যান্সে।
নৈশ-বিরতির সময় দেখলাম পুণে-র জার্সি পরা কাটাকাটা চেহারার এক মহিলা প্রেস লাউঞ্জের পাশ দিয়ে হাসিমুখে ঘোরাফেরা করছেন। এক সাংবাদিক আলাপ করিয়ে দিলেন, ইনি আশিস নেহরার স্ত্রী। জার্সির পিছনেও লেখা নেহরা। মহিলা আনন্দবাজারকে বললেন, “একশো বিরানব্বই হয়ে গিয়েছে। অনেক ভাল বোধ করছি।” নেহরা যে দিন বেঙ্গালুরুতে শেষ ওভার করছিলেন, সে দিন আপনি কোথায় ছিলেন? শ্রীমতি নেহরা মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ওই রাত্তিরটা আর মনে করাবেন না। মুম্বইয়ে আমার মা-র বাড়িতে বসে টিভি দেখছিলাম। কী মর্মান্তিক!”
খেলা প্রথম স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউটে যাওয়ার সময় মনে হল, মহিলাকে খুঁজে দেখলে মন্দ হয় না। আজ না তাঁকে মাঠে বসে স্বামীর আরও একটা মর্মান্তিক ওভার প্রত্যক্ষ হয়! কারণ ৯ ওভারে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস তুলে ফেলেছে ৮৭-১। এমন মারছেন পিটারসেন আর সহবাগ যে তখন মনে হচ্ছে, সৌরভ এখুনি দু’টো জায়গায় ফিল্ডার দাঁড় করালে ভাল করবেন। একটা রাজঘাটে। আর একটা কোটলার পুরনো কেল্লায়। কারণ বল মোটামুটি যা পড়ছে, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে রবিন উথাপ্পা সহজ রান আউট মিস করেছেন সহবাগের। মনে হচ্ছে ম্যাচ শেষে লিখতে হবে ওটাই টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
ঠিক এই রকম অবস্থায় হঠাৎ দেখা গেল পুণে বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড দৌড়তে দৌড়তে মাঠে ঢুকে পড়েছেন। আর পুণে টিম ততক্ষণে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ‘হাডল’ করছে। স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউটে ‘হাডল’ সচরাচর হয় না। হয় ইনিংসের শুরুতে। দেড় মিনিটের মধ্যে দেখা গেল এটা কোনও চমকই ছিল না। চমক যে এ বার শুরু হতে যাচ্ছে। বল হাতে তুলে নিলেন সৌরভ। গোটা টুর্নামেন্টে বল করেননি। বাংলার হয়ে চলতি মরসুমেও কচিৎ হাত ঘুরিয়েছেন। সেই তিনি এ রকম সময়? দিল্লি কী তা হলে কুড়ি ওভার আসার আগেই ১৯৩ তুলে ফেলবে? ব্যাটসম্যান পিটারসেন। যিনি আগের ম্যাচে আইপিএলের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরিটাই শুধু করেননি, আজও এমন ভঙ্গিতে ব্যাট করছেন যেন দ্রুতই ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলতে চান। সেই তিনি কি না প্রথম বলে বোল্ড! বলটা সামান্য নিচু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখন কোটলার নিচু-উঁচু দেখার সময় নেই। তারা মুগ্ধ হয়ে সৌরভকে দেখছে। যিনি মুষ্টিবদ্ধ হাতে তিরিজ গজি স্প্রিন্ট দৌড়লেন। দু’বছর আগের আইপিএলে ইডেনে পঞ্চাশ করে বুক ঠুকেছিলেন গ্যালারিতে বসে থাকা ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের দিকে। আজ এত উত্তেজিত ভাবে দৌড়তে দৌড়তে কী বলছিলেন, শাহরুখ আমি বেঁচে আছি?
দু’এক ওভারের মধ্যেই বোলার সৌরভ তাঁর অবিশ্বাস্য লীলায় ম্যাচ ঘুরিয়ে দিলেন। ইরফানকেও ফিরিয়ে দিলেন। রান রেট থমকে গেল। শেষ ওভারে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ সহজতম ক্যাচ না ছাড়লে আজ তাঁর তিন উইকেট হয়। কিন্তু তার চেয়েও রোমাঞ্চকর এই উত্থান।
যখন ব্যাট করে উঠেছেন সেই ৩৫ বলে ৪১-কে সবাই ভাল বলছে, কিন্তু দুর্দান্ত কিছু বলছে না। ১১৭ স্ট্রাইক রেট। কিন্তু তা-ও উৎপাদন করছে নানান মন্তব্য। যেমন কেপলার ওয়েসেলস বললেন, “একশো চল্লিশ কিলোমিটার খেলতে ওর অসুবিধা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। গিলক্রিস্টেরও একই সমস্যা। নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেললে এটা হবেই।” অন্য প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তখন সহানুভূতির সুরে বলছেন, মস্তিষ্কটা অসাধারণ। তাই আজও এত ভাল নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু শরীর কী করে এই চল্লিশ বছর বয়সে সাড়া দেবে?
পুণে লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল পরপর তিনটে অ্যাওয়ে ম্যাচের মধ্যে অন্তত একটা জিতে ফিরবে। তাদের ইনিংস শেষ হওয়ার পর মনে হল লক্ষ্যটা সফল হতে যাচ্ছে জেসি রাইডারের জন্য। যিনি ৫৮ বলে ৮৬ করে দিয়েছেন। একই রকম ঝকমকে সেই স্টিভ স্মিথ। যিনি ১৩ বলে অপরাজিত ৩৪। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্রমাগত তাঁকে মনে হচ্ছে জন্টি। আর ব্যাট হাতে পুরোনো পন্টিং।
ভাবাই যায়নি ১৯২ তাড়া করে দিল্লি এমন মার-মার কাট-কাট প্রদর্শনী শুরু করে দেবে। প্রদর্শনী বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, সম্প্রতি ক্লাইভ লয়েডকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আইপিএল আর টেস্ট ম্যাচের তফাত কী? লয়েড বলেছেন, “টেস্ট ম্যাচটা হল পরীক্ষা, যেখানে পাশ ফেল আছে। আইপিএল হল প্রদর্শনী যেখানে কেউ উত্তীর্ণও হয় না। অনুত্তীর্ণও না।” লয়েড জানেন না আইপিএল এখন তাঁদের আমলের প্যাকার ক্রিকেটের মতোই হৃদয়হীন, হিংস্র এবং কঠিনতম পরীক্ষা। প্যাকার যেমন খারাপ খেললে বলতেন, স্ট্রেট সিডনি থেকে কোয়ান্টাসের ফ্লাইট ধরে বাড়ি চলে যাও। তেমনই এখানেও মালিকরা নির্মম। তাঁরা অজুহাত চান না। জয় দেখতে চান।
পুণে কর্তারা হারতে হারতে যেমন হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। আজ উথাপ্পার ফের দু’টো সহজ ভুল আর আউটফিল্ডে দু’টো সহজ ক্যাচ পড়ার সুযোগ যদি দিল্লি নিতে পারত, তা হলে মনে হয় না হাউসকাসে আশিস নেহরার ভাইয়ের রেস্তোঁরায় রাতের পার্টিটা হত বলে। এখনকার মতো দাঁড়াল, মিশন সেমিফাইনালে বাকি রইল আর চারটে ম্যাচ। হাতে খেলা ন’টা। আর সঙ্গী? কোটলায় আত্মবিশ্বাস পেয়ে যাওয়ার পর বাকি আইপিএলের জন্য নতুন ‘ম্যাসকট’।
কী আবার-- ব্যাঘ্রগর্জন!

কেপিকে আউট করে প্রচণ্ড স্বস্তি পেয়েছিলাম। সে জন্যই ও ভাবে দৌড়ই। আর সহবাগ আউট হওয়ার পরেই আমরা ম্যাচে ফিরে আসি।
দারুণ বল দাদা! পরের বার উইকেট পাওয়ার আগে মাথায় জেল লাগিয়ে রেখো! আমার হেয়ার জেলটাই দাদাকে দেব। ওটা তো গত তিন মাস ব্যবহারই করিনি!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.