আমলাদের অতি-সাবধানতার কারণ ও সংস্কার থমকে যাওয়া, সরকারি কাজকর্মের গতি শ্লথ হয়ে পড়া নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে এ বার ঘরে-বাইরে সরব হলেন কেন্দ্রের দুই শীর্ষ নেতা। সরকারের সাহসী মুখ তুলে ধরতে দেশে মুখ খুললেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আমেরিকায়।
সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমলাদের নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও নিজেদের কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মনমোহন। তাঁর বক্তব্য, পরে কেউ প্রশ্ন তুলবে কি না, কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে কি না, এ সব ভেবে আমলারা যেন থমকে না যান। আমলাদের যাতে কোনও ভাবে বলির পাঁঠা না করা হয়, সে দিকে নজর রাখছে সরকার। তাঁরা যেন সরকারের রাজনৈতিক রং না দেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যান। এরই পাশাপাশি প্রণববাবু আজ ওয়াশিংটনে বসে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের বাজার সম্পর্কে সে দেশের বণিক মহলের আশাভঙ্গ হওয়ার কোনও কারণই নেই। অর্থমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্য, সরকার সংস্কারের পথেই রয়েছে।
প্রণববাবু জানান, পেনশন, বিমা ও ব্যাঙ্কিং আইন সংশোধনের প্রাথমিক আইনি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শেষ করেছে সরকার। তাঁর কথায়, “আমার আশা, ২০১২ সালেই এই তিনটি আইনের সংশোধনী পাশ করিয়ে নিতে পারবে সরকার। তবে এর জন্য অবশ্যই বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এবং সেই প্রক্রিয়া ঠিকঠাক ভাবে এগোলে পণ্য পরিষেবা কর বিলও সংসদের আগামী অধিবেশনে পাশ হতে পারে। নূন্যতম ১৫টি রাজ্য মেনে নিলে ওই করও চলতি বছরেই চালু করা যেতে পারে।” এর পাশাপাশি প্রণববাবুর দাবি, “প্রত্যক্ষ কর কাঠামোও আগামী আর্থিক বছর থেকে চালু হবে।” সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এই বার্তাটিই অর্থমন্ত্রী তুলে ধরার চেষ্টা করলেন যে, জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতার মধ্যেও ইউপিএ সরকার আর্থিক সংস্কারে দৃঢ় পদক্ষেপ করে চলেছে।
সংস্কার নিয়ে এই বিতর্কটা তৈরি হয়েছে খাস অর্থ মন্ত্রকেরই আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর মন্তব্যে। গত বুধবার ওয়াশিংটনে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এ বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, শরিকি গণতন্ত্রে সংস্কার ও নীতি-নির্ধারণ শ্লথ হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রে একটি দলের সরকার থাকলে তা হত না। স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি এতে সরকারকে আক্রমণ করার নতুন হাতিয়ার পেয়ে যায়। মুশকিলে পড়েন কংগ্রেসের নেতারা। আর্থিক সংস্কারের কাজ কিন্তু চলছেই এই জাতীয় কিছু সাফাই দেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো দলের নবীন নেতা থেকে শুরু করে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া। কিন্তু এটাও ঘটনা যে বিরোধীরাই শুধু নয়, জোট শরিকদের আপত্তির জেরেই এখনও বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দিতে পারেনি মনমোহন সরকার। প্রতিরক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ আনা যায়নি। আটকে আছে বিমা-ব্যাঙ্কিং-পেনশন ক্ষেত্রের সংস্কার। পণ্য-পরিষেবা কর ও প্রত্যক্ষ কর বিধিও চালু করা যায়নি। ফলে কংগ্রেসের সাধারণ নেতা ও মুখপাত্ররা শিক্ষাবিদ কৌশিকবাবুর বক্তব্যকে এক-কথায় খারিজও করে দিতে পারেননি। মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি তাই স্মরণ করিয়ে দেন বিশ্বের মন্দা পরিস্থিতির কথা। কৌশিকবাবুও বলেছেন, ২০১৪-য় বিশ্বে ফের মন্দার আশঙ্কা রয়েছে। তা কাটিয়ে উঠতে পারলে ভারতেও সংস্কার গতি পাবে। ঘটনাচক্রে ভারতে লোকসভা ভোট হওয়ার কথা ওই বছরেই। কৌশিকবাবুর বক্তব্য থেকে একটা মহল এই ব্যাখ্যা ধরে নেয় যে, ইউপিএ-র বর্তমান জোট সরকারের আমলে সংস্কার এগোনোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এই নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন পড়ে যায়। সরকারের বিরুদ্ধে মূল যে দু’টি অভিযোগ উঠে আসে, তা হল: এক, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার শ্লথ, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়েছে। দুই, বিরোধীদের শুধু নয়, জোট শরিকদেরও সহযোগিতা আদায় করতে কংগ্রেস ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে সংস্কার থমকে যাচ্ছে। এই নিয়ে মার্কিন বণিকসভার তরফে গোপন ‘মেমো’-ও পাঠানো হয়েছে হোয়াইট হাউসে। মনমোহন আজ প্রথম অভিযোগ মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন দিল্লিতে, সিভিল সার্ভিসেস দিবসের অনুষ্ঠানে। আর প্রণববাবু সংস্কার নিয়ে আশঙ্কার মেঘ কাটানোর চেষ্টা করেছেন ওয়াশিংটনে, পিটার জি পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক্সে এক অনুষ্ঠানে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, “দুর্নীতি দমনের নামে সিভিল সার্ভেন্টদের যাতে বলি পাঁঠা না করা হয়, সেটা দেখা সরকারের দায়িত্ব।” আবার একই সঙ্গে সিদ্ধান্তহীনতার রোগ থেকে আমলাদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যাঁরা কোনও সিদ্ধান্তই নেন না, তাঁর সব সময়েই নিরাপদ। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যায়, সমাজ ও দেশের প্রতি তাঁর অবদান শূন্য।” এই প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, দেশের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনে গত এক বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে সরকার। দেশ এ বার দ্বাদশ পঞ্চবাষিকী পরিকল্পনায় প্রবেশ করছে। দেশের সকলকে নিয়ে সমৃদ্ধির দিকে এগোতে দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপাতে হবে আমলাদেরও। আর কী বললেন অর্থমন্ত্রী? তিনি অবশ্য এ দিনও স্বীকার করে নেন, জোট রাজনীতির কারণে গত এক বছরে আর্থিক সংস্কারের গতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। তবে তাঁর কথায়, “এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি। কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে। বৃদ্ধির হার বাড়াতে গত কয়েক মাসে স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও করেছি। ২০১২-১৩-র বাজেট প্রস্তাবে তার রূপরেখাও তুলে ধরেছি।”
জোট রাজনীতির ‘লাগাম’ অটুট রেখে অর্থমন্ত্রীর সংস্কার-পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন সরকারের নেতৃত্বের কাছে।
|