|
|
|
|
রাজনীতির ছুঁতমার্গ ছেড়ে গণতন্ত্রের দিশা সন্ধান |
অনিন্দ্য জানা |
বাঘে-কুমিরে একঘাটে জল খেল।
শনিবারের বারবেলায়।
ঘাটের নাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। জলের নাম ‘গণতন্ত্র’। যা সর্ব অর্থেই, বাঘ এবং কুমিরের কাছে ‘জীবন’ও বটে।
হেঁয়ালি না-করে সোজা সোজা বলা যাক। উপলক্ষ: সেন্ট জেভিয়ার্সের বাৎসরিক বিতর্কসভা। বিষয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে-আনা বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার ছাড়া ভারতে গণতন্ত্র নিষ্ক্রিয়।
প্রস্তাবের বিরোধিতায় (স্বভাবতই। সঞ্চালক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় তো বিতর্কের মাঝখানেই বললেন, ‘পলিটিক্স অফ কনসেনসাস’। অর্থাৎ কিনা, ঐকমত্যের রাজনীতি) একজোট তৃণমূলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়, তাঁর দলেরই রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়, কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক তথা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ এবং সিপিএমের তরুণ নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি এই সেদিন দক্ষিণ কলকাতা লোকসভায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন)।
অধুনা রাজ্য-রাজনীতির ‘জ্যোতিপ্রিয়তা’য় এই চার জনের এক মঞ্চে আসাটাই ‘খবর’। তা বৃহত্তর পর্যায়ে গেল, যখন তাঁরা একই কারণে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়লেন। হোক না তা বিতর্কসভা। যেখানে ঋতব্রত সশ্রদ্ধ উচ্চারণ করলেন, “আশুতোষ কলেজে আমার শিক্ষক সৌগত রায়।” যেখানে দেখা গেল, তরুণ বামপন্থী নেতা বক্তব্য পেশ করে আসনে ফেরার সময় হাততালি দিচ্ছেন তাঁর বিরোধী শিবিরের তিন প্রবীণ রাজনীতিক!
প্রস্তাবের পক্ষে বক্তা ছিলেন দুই চিকিৎসক কুণাল সরকার এবং সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গী ব্যারি ও’ব্রায়েন। যিনি এই সে দিন পর্যন্তও ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ থেকে রাজ্য বিধানসভায় সিপিএমের ‘মনোনীত’ বিধায়ক। ঘটনাচক্রে, যাঁর ভাই ডেরেক আপাতত তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায়। ছিলেন অধ্যাপিকা অনন্যা চক্রবর্তী। |
|
ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুখেন্দুশেখর রায়, সৌগত রায় ও অরুণাভ ঘোষ।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ আয়োজিত বিতর্কসভায়। মঞ্চে ওঠার আগে। |
প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁরা তীক্ষ্ন শব্দে রাজনীতির কারবারিদের বিঁধেছেন। কুণাল যেমন বলেছেন, “সৌগতবাবু গত ১৮ থেকে ২৪ মাস নিখোঁজ! তাঁর গলা আর পাওয়া যায় না! কেন? ঋতব্রত দারুণ বক্তা। কিন্তু প্রকাশ কারাটের অধীনে যাঁর রাজনীতি করা, তিনি আমাদের তরফে শুধু সহানুভূতিই পেতে পারেন!” অনন্যা তেমন কোনও ‘রাজনৈতিক’ আক্রমণের পথে যাননি। তিনি বরং সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেছেন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার কী ভাবে পঞ্চায়েতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ফেরানোর বন্দোবস্ত করেছেন। শ্রোতাদের হাততালি সবচেয়ে বেশি কুড়িয়েছেন অবশ্য ব্যারি (সৌগতবাবু পরে যাকে ‘স্রেফ বিনোদনী’ বলে আখ্যা দেবেন)। যখন তিনি নাম না-করেও সমান তালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কারণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দোষ দিয়েছেন (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পর বিধানসভা এবং সরকার পুরোপুরি অথর্ব হয়ে পড়েছিল) আবার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করতে গিয়ে ইদানীং চালু এসএমএস উদ্ধৃত করেছেন, “এমন এক সরকার, যারা ধর্ষণের ঘটনার চেয়ে ব্যঙ্গচিত্রকে বেশি গুরুত্ব দেয়!” মমতাকে তীক্ষ্নতর আক্রমণ করেছেন প্রকারান্তরে এই পরামর্শ দিয়ে যে, ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ নামটা ‘ম্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ করে নেওয়া হোক। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর অপসারণ, সাম্প্রতিক রঙ্গচিত্র-কান্ড ও ফেসবুক নিয়ে মমতাকে খোঁচা দেওয়ার পাশাপাশিই সন্দীপ সৌগতবাবুকে বিঁধেছেন, “উনি কী করে সিপিএমের বক্তার পাশে বসে আছেন? ওঁর তো ওদের সঙ্গে এক বাতাসে নিশ্বাস নেওয়াও বারণ!”
এ সবই এমন বক্তব্য, যা প্রতিদিন বিভিন্ন সময়ে ঋতব্রত বলে থাকেন। আর সৌগতবাবুরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে তা-ই এখনও বলে থাকেন, যা বলেছেন ব্যারি। কিন্তু বিতর্কসভার আপসের লড়াইয়ে নিজের নিজের রাজনৈতিক ধারণা বলতে গেলে তো খেলা শুরুর আগেই হেরে বসতে হয়!
রাজনীতিকরা তা-ই প্রাথমিক ভাবে জোর দিলেন প্রস্তাবের ‘অবাস্তবতা’র উপর। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগতবাবু যেমন বললেন, “আমাদের গণতন্ত্রের অনেক দোষ আছে। কিন্তু যে প্রস্তাব এসেছে, তা বাস্তবায়িত হলে তো অরাজকতা দেখা দেবে! আমাদের দেশে একটা নির্বাচন করতেই বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। তার পর যখন খুশি নির্বাচন? আমাদের দেশে দুটো কমিটি তৈরি হয়েছিল এই দাবি নিয়ে। কোনওটাই এমন কোনও পরামর্শ দেয়নি!” বস্তুত, দমদমের সাংসদ সৌগতবাবুর কথায়, “এই প্রস্তাব নৈরাজ্যবাদীদের। আমরা গণতন্ত্রবাদী। আমরা নৈরাজ্য চাই না।” অরুণাভবাবুর বক্তব্য “আইনজীবী হিসেবে শিখেছি, অবাস্তবতায় বিশ্বাস করার চেয়ে সত্যের জন্য পাগল হওয়াও ভাল। বিপক্ষের বক্তারা বাস্তবটা বুঝুন।” বিভিন্ন প্রশ্নে মমতাকে কটাক্ষে অভ্যস্ত কংগ্রেসের নেতা অবশ্য সুকৌশলে এ-ও বলে গেলেন যে, “আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি নির্বুদ্ধিতা। বিরোধী দলে থাকার সময় আমরা যা খুশি বলি। ক্ষমতায় এলে তখন বুঝি, আসল ব্যাপারটা কী।” সবে তালি পড়া শুরু হয়েছিল। অরুণাভবাবু চলে গেলেন গুজরাত, নবনির্মাণ সমিতি, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাইয়ের মতো ‘নিরীহ’ প্রসঙ্গে। |
|
মঞ্চে কুণাল সরকার, অনন্যা চক্রবর্তী, ব্যারি ও’ব্রায়েন ও সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। |
বিপক্ষের বক্তাদের ‘হাহাকারবাদী’ বলে দলের ‘লাইন’ মেনে জনলোকপাল বিলের বিরোধিতা করলেন সুখেন্দুবাবু। বাকিটা তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রস্তাবের বিরোধিতা।
বিতর্কের মঞ্চকে ঋতব্রতও ‘ব্যবহার’ করলেন তাঁর দলের ‘লাইন’ মেনেই। বললেন, “গণতন্ত্র মানে স্রেফ কাউকে সংসদে পাঠানো নয়। গণতন্ত্র মানে রাজ্যের শেষ প্রান্তের, গ্রামের শেষতম মানুষটিকে তার অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া। যা করেছিলেন প্রয়াত জ্যোতি বসু।” বললেন, “আমার দল সংসদে সংখ্যায় কম হলেও প্রভাবে সারা দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” বললেন, “আমি যে দলের সদস্য, তারা এখনও আন্তরিক ভাবে বিপ্লবে বিশ্বাস করে।”
তার পরেই বলে বসলেন, “গণতন্ত্রে আসল কথা হল জনতা। তারা কোন চ্যানেল দেখবে, কোন খবরের কাগজ পড়বে, সেটা কেউ ঠিক করে দিতে পারে না! নেতা-নেত্রী আসেন এবং যান। কিন্তু জনতা থাকে। তারা কী চায়, সেটা তারাই ঠিক করে নেবে।”
সাময়িক ‘জোটসঙ্গী’ হলেও এ সব কথা হজম করা সৌগতবাবুর পক্ষে কঠিন। অতএব, নিজের পক্ষের বক্তব্যের সারবত্তা বলতে উঠে (প্রস্তাবের পক্ষের সারার্থ বলতে গিয়ে যেমন ঋতব্রতকে লক্ষ্য করে কুণাল বলবেন, “এ পৃথিবীতে কমিউনিজম হল ডাইনোসরের আই-প্যাড ব্যবহার করার সামিল”) তৃণমূলের প্রবীণ নেতাকে বলতেই হল, “জনতা দেখিয়ে দিয়েছে, অত্যাচার-অনাচার-অবিচারের জবাব ব্যালটে দেওয়া যায়। দেখিয়ে দিয়েছে, বন্দুকের চেয়ে আঙুলের জোর বেশি। অনেকে বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু এ রাজ্যে সেটা হয়েছে!” তার পর আরও এক ধাপ এগিয়ে সরাসরি তরুণ বামপন্থীকে কটাক্ষ, “যারা এখনও বিপ্লবে বিশ্বাস করে, তারাও কিন্তু গণতন্ত্রের পথে আসতে বাধ্য হয়েছে!”
বিতর্ক-শেষে শ্রোতাদের হাত-তোলা ভোটে হার-জিত কী হল?
বিতর্কের আগে ঘরোয়া আড্ডায় অনন্যা বলেছিলেন, “ওদের যা টিম! এ তো ব্র্যাডম্যানকে পাড়ার বোলারের বল করা!” কিন্তু হেরে গেলেন রাজনীতিকরা। প্রেক্ষাগৃহের স্বল্পসংখ্যকের রায়ে ‘গণতন্ত্র পরাজিত’, এমন অবশ্য বলা যায় না। তবে শহুরে জনতার একাংশের রাজনীতিতে যে ‘বিতৃষ্ণা’ জন্মেছে, সেটুকু বলা যায় বৈকি! সেটাও বোধহয় প্রত্যাশিতই ছিল। গণতন্ত্রের রক্ষকদের নিজেদের মধ্যেই যে স্ব-বিরোধিতা! বাঘে-কুমিরে একঘাটে জল খেল বটে। কিন্তু জল ঘুলিয়ে গেল।
ঘোলা জলে মাছ ধরে নিয়ে গেলেন অ-রাজনীতিকরা। যাঁরা মনে যকরেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে-আনা বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার-ব্যতিরেকে সত্যিই নিষ্ক্রিয় ভারতের গণতন্ত্র।
|
শনিবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি। |
|
|
|
|
|