|
|
|
|
গল্প বলেই ভরে ওঠে দিনকর ভাইয়ার ঝুলি |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
গল্পদাদুর আসর বা শিশুমহল-এর স্বর্ণযুগ গত হয়েছে। কিন্তু তেমন করে গল্প বলতে পারলে তার শ্রোতা যে কমেনি, সেটাই প্রমাণ করে চলেছেন চক্রধরপুরের ‘গল্প-দাদা’ দিনকর শর্মা। ঝাড়খণ্ড ও বিহারের স্কুলপড়ুয়াদের কাছে তাঁর নাম ‘দিনকর ভাইয়া, দ্য স্টোরি টেলার’।
একটা সময় ছিল যখন স্কুলে দু’টো ক্লাসের ফাঁকে দস্যিপনা এড়াতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেই কাউকে গল্প বলার দায়িত্ব দিতেন মাস্টারমশাই। আর যেই না শুরু হত গল্প বলা, ক্লাসঘরের শব্দদৈত্য বোতলবন্দি হয়ে যেত ম্যাজিকের মতো। কোনও কোনও মাস্টারমশাই নিজেরাও গল্প শোনাতেন পড়ানোর ফাঁকে। ইদানীং তথ্য-প্রযুক্তি আর টেলিভিশনের দৌলতে বদলে গিয়েছে বিনোদনের ধরন। বই পড়ার প্রবণতা কমেছে। দিনকর শর্মা কিন্তু গল্প শোনানোকেই তাঁর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বছর চল্লিশের অকৃতদার দিনকরকে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষই আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান গল্প বলাতে। শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়ে এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও গল্প শোনানোর ডাক পাচ্ছেন। |
|
গল্প শোনাচ্ছেন দিনকর শর্মা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
নানা মহলে প্রশংসিতও হয়েছেন।
কখনও মুন্সি প্রেমচন্দ-র ‘বঢ়ে ভাইসাহাব’, কখনও জ্ঞান চতুর্বেদীর ‘ডরা হুয়া আদমি’। দিনকরের তালিকায় রয়েছে দেশ-বিদেশের বেশ কয়েক জন প্রখ্যাত সাহিত্যিকের ছোটগল্প। দিনকরের কথায়, “বই দেখে পড়লে গল্পটা গল্পই থেকে যায়। তাই আমি স্মৃতি থেকে গল্পটা বলি।”
শুরু করেন আটপৌরে ভাবে। কোনও নাটুকেপনা নেই। নেই কোনও আবহসঙ্গীত। কিন্তু উপস্থাপনাটি অভিনব। স্পষ্ট-সাবলীল উচ্চারণে কেটে কেটে এক একটা বাক্য বলেন। গল্পে ঘটনার বর্ণনা, চরিত্রের সংলাপ কিংবা লেখার বিন্যাসকে অদ্ভুত এক মুন্সিয়ানায় ভিন্ন ভিন্ন স্বরক্ষেপণে উপস্থাপন করেন শ্রোতার কাছে। দিনকরের গল্প শুনে শ্রোতারা কখনও কেঁদে ফেলেন, কখনও হেসে ওঠেন। গল্প শেষ হওয়ার পরও কাটতে চায় না মুগ্ধতার ঘোর।
সাবেকি বৈঠকী আড্ডা, দাপুটে গল্প-বলিয়ে আর নানা আষাঢ়ে গপ্পের আসর এখন আর কই? ডমরুধর বা ঘনাদা-রা যেমন নিজেরাই গল্প ফাঁদতেন, দিনকর অবশ্য সে রাস্তায় হাঁটেননি। তাঁর ঝোঁক সাহিত্যে। কিশোর বয়সে প্রেমচন্দের ‘কফন’ দিয়ে প্রথম গল্প পড়ার অভ্যাস শুরু হয়েছিল। ২০০৫ সালে চক্রধরপুরের একটি স্কুলে গল্প শোনালেন প্রথম। এখন ঝাড়খণ্ড ও বিহারের স্কুল-কলেজের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে অনুষ্ঠান করে চলেছেন দিনকর। গত সাত বছরে সারা দেশে চারশোটিরও বেশি গল্প শোনানোর অনুষ্ঠান করেছেন। সাধারণত, আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানে গড়ে একটা গল্প শোনান। পারিশ্রমিক হাজার থেকে দু’হাজার টাকা। দিনকরের কথায়, “এখন মানুষের হাতে সময় কম। তাই ছোটগল্প শোনাই।” কয়েকটি বড় গল্প ও উপন্যাসের সারসংক্ষেপ তৈরি করেছেন। তার মধ্যে শংকর, প্রবোধকুমার সান্যালের লেখাও রয়েছে।
সমাজতাত্ত্বিক সুধীর চক্রবর্তী মনে করতে পারেন, ছোটবেলায় স্কুলে অনেক সময় পেশাদার গল্প-বলিয়ের আর্বিভাব হত। দশ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে গল্প শুনতে হত। “পরে বিভিন্ন সময় গ্রামীণ মেলায় এ ধরনের কিছু চরিত্র দেখেছি। অগ্রদ্বীপের মেলায় এক গল্প-বলিয়েকে দেখেছিলাম। সে তার গল্পে শ্রোতা-দর্শককেও ঢুকিয়ে নিত।” রেডিওতে এক সময় গল্প বলা বা ধারাবাহিক উপন্যাস পাঠের যে অনুষ্ঠান হত (সম্প্রতি এফএমে সেই গল্পপাঠের আসর আবার ফিরেছে এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়ও হয়েছে) বা দূরদর্শনেও শিশুদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে গল্প বলার রেওয়াজ ছিল, তার সঙ্গে এই গল্প-বলিয়েদের এক করতে চান না তিনি। কারণ, সেখানে কোনও স্টুডিওর ঘেরাটোপ নেই। সবটাই ঢালাও শ্রোতার সামনে ‘জীবন্ত’ কথকতা। যদিও এই কথকতায় ধর্মচর্চা নেই। পাণ্ডবানী বা রামায়ণ গানের মতো নেচেগেয়ে পুরাণকে নতুন চেহারায় উপস্থাপনাও নেই।
পশ্চিমের বহু দেশে কিন্তু ‘স্টোরি টেলিং’কে রীতিমতো একটি স্বতন্ত্র শিল্প বলে ধরা হয়। তার জন্য আছেন বহু পেশাদার, বহু সংগঠন, গল্প বলার একাধিক উৎসব। বসন্তের প্রথম দিনটিতে উত্তর গোলার্ধে আর শরতের প্রথম দিনটি দক্ষিণ গোলার্ধে ‘আন্তর্জাতিক গল্প বলা দিবস’ বলে পালন করেন তাঁরা। কলকাতায় ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং অক্সফোর্ড বুক স্টোর-এর আয়োজনে বছর কয়েক আগেও বেশি কিছু গল্প বলার অনুষ্ঠান করা হয়েছে।
দিনকর শর্মা অবশ্য এত কিছু ভেবে এগোননি। নব্বইয়ের দশকে চক্রধরপুরের কলেজে ইকনমিক্স-এ অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা ছেড়ে পথ-নাটিকার দল খোলেন। তাঁর কথায়, “প্রথাগত শিক্ষায় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। একেবারে নতুন কিছু করার ইচ্ছে থেকে প্রথমে এলাকার সমস্য্য নিয়ে নুক্কড়-নাটক শুরু করি। পরে মঞ্চে ভিন্ন আঙ্গিকের নাটক।” ‘ন্যাশন্যাল স্কুল অফ ড্রামা’য় নাটকের ওয়ার্কশপ করা দিনকর তাঁর ভিন্নধর্মী নাটকের জন্য ২০০৪ সালে সারা ভারত নাট্য প্রতিযোগিতায় সেরা নির্দেশকও নির্বাচিত হন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই মঞ্চ থেকে বিদায়! অতঃপর, গল্প বলাকেই পেশা করে নেওয়া। বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী। তিন ভাইয়ের মধ্যে দিনকর মেজ। বড়দাদা মুম্বই-প্রবাসী প্রমোদ শর্মা বলিউডে হিন্দি ছবির সংলাপ-লিখিয়ে। ছোট ভাই অনুরাগ চক্রধরপুরের একটি স্কুলের তাইকোন্ড-প্রশিক্ষক। দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
দিনকর এখন বাংলা শিখছেন। আগামী দিনে বাংলা ভাষায় গল্প শোনানোর খুব ইচ্ছে যে! |
|
|
|
|
|