ব্যঙ্গ-বিতর্ক উস্কে দিল উনিশ শতকে ‘মানহানি’র স্মৃতি
ব্যঙ্গাত্মক ছবি নয়। নিটোল একখানি কবিতা। তার জেরেই উনিশ শতকীয় বাঙালি সমাজে অভিজাত ঘরের এক বধূর মানহানির অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল কলকাতা।
ব্রিটিশ আমলে হাইকোর্ট থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য মামলার নথি ‘ক্যালকাটা উইকলি নোটস-১’ এবং সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য হাইকোর্ট অ্যাট ক্যালকাটা ১৫০ ইয়ার্স: অ্যান ওভারভিউ’ দু’টি বইতেই ওই পুরনো মামলার কথা বলা হয়েছে। নেট-রসিকতার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানহানির অভিযোগের প্রসঙ্গ আরও অজস্র মামলার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।
হেরম্বচন্দ্র মৈত্র
কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ
কখনও রাজনৈতিক নেতা বা বিশিষ্ট জনেদের মানহানি, কখনও বা অশ্লীলতার অভিযোগ। গত বিধানসভা ভোটের আগে সিপিএম নেতা গৌতম দেবের অভিযোগ নিয়ে তৃণমূলের মামলা যেমন রয়েছে, তেমনই কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের মানহানির মামলাও রয়েছে। হাইকোর্ট এবং ব্যাঙ্কশাল কোর্টে এই সব মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।অশ্লীলতা বা অপসংস্কৃতি ছড়ানোর অভিযোগে মামলাও নেহাত কম নয়। নেটে মমতার ছবি ঘিরে ‘শালীনতা ক্ষুণ্ণ’ হওয়ার অভিযোগে সে-সব প্রসঙ্গও উঠছে। ঘটনা হল, অশ্লীলতার অভিযোগগুলির বেশির ভাগই ধোপে টেকেনি। সমরেশ বসুর ‘বিবর / প্রজাপতি’ বা বুদ্ধদেব বসুর ‘রাতভোর বৃষ্টি’ নিয়ে একদা নিউজপ্রিন্টের কালি কম খরচ হয়নি। শেষ পর্যন্ত কিন্তু হাইকোর্টের রায় লেখকদের পক্ষেই ছিল। প্রতাপ মঞ্চে কেতকী দত্ত অভিনীত ‘বারবধূ’ নাটকটিও অপসংস্কৃতির অভিযোগে কিছু দিন বন্ধ ছিল। হাইকোর্টে মামলায় জিতে ফের স্বমহিমায় ফিরে আসে। হাইকোর্টে আশির দশকে ঊষা উত্থুপের বিরুদ্ধে বাম জমানার তদানীন্তন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর অভিযোগও উড়িয়ে দেয় হাইকোর্ট। ঊষার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ‘ডিস্কো’ নাচ-গান করেন, যা অশ্লীল। আদালতের রায়ে বলা হয়, ডিস্কো শব্দটির মানে, যে গান ডিস্কে রাখা। সরকারি ছাড়পত্র ছাড়া গান ডিস্কবন্দি হয় কী করে? নব্বইয়ের দশকে তসলিমা নাসরিনের ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি ঘিরে মানহানি সংক্রান্ত অভিযোগ উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার যুক্তিতে বইটি এ রাজ্যে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে বামফ্রন্ট সরকার। পরে হাইকোর্ট বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য সরিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়।
এ সবই সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনা। মমতার ছবি-বিতর্কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০০ নম্বর ধারায় মানহানির অভিযোগ দায়ের হয়েছে (যদিও মুখ্যমন্ত্রী নিজে বা তাঁর আত্মীয়রা কেউ অভিযোগ করেননি। মানহানির অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে সেটাই নিয়ম)। ওই ৫০০ নম্বর ধারাতেই মানহানির দায়ে পড়েছিলেন উনিশ শতকের কবি কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ (বন্দ্যোপাধ্যায়)। ব্যঙ্গাত্মক লেখালেখির জন্য বেশ নাম-ডাক ছিল তাঁর। ফকিরচাঁদ বাবাজি ছদ্মনামে লেখা তির্যক গদ্য-পদ্যে মাঝেমধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো স্বনামধন্যদেরও ‘ব্যঙ্গ’ করতে কসুর করতেন না তিনি।
কিন্তু ‘রুচি-বিকার’ নামে একটি কবিতা লিখে কালীপ্রসন্ন মুশকিলে পড়ে গেলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। তিনি সে-কালের ব্রাহ্ম সমাজের এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি। কলকাতা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ, ইংরেজি সাহিত্যের এমএ এবং পিএইচডি হেরম্বচন্দ্র তাঁর পাণ্ডিত্য এবং বৈদগ্ধ্যের জন্যও সবার শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।
১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘রুচি-বিকার’। হেরম্বের অভিযোগ ছিল, ওই কবিতা তাঁর স্ত্রী কুসুমকুমারী মৈত্রকে ‘ব্যঙ্গ’ করেই লেখা। কুসুমকুমারী সুন্দরী, পরিশীলিত, মুক্ত মনের মহিলা। ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চোখে পড়ত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। হাইকোর্টের পুরনো মামলা-সংক্রান্ত বইতে ওই কবিতার আগাগোড়া উদ্ধৃতি রয়েছে। ‘কুসুম’ শব্দটা বারবার ব্যবহার করে কালীপ্রসন্ন লেখেন,
কুসুমের কোমলতা মাধুরী অপার
কিন্তু তার পবিত্রতা
জানি তাতে দুষ্ট অলি করেছে বিহার
লুটেছে সঞ্চিত মধু মধুর ভাণ্ডার॥
"
কখনও কুসুমের অন্য প্রতিশব্দ (প্রসূন) নিয়ে লেখা হয়,
পদে পদে প্রসূনের দেখি অনাচার
আজি উপেন্দ্রর ভোগ্য
কালই হেরম্বের যোগ্য
দেখিলে রুচির দোষ না হয় কাহার?

হেরম্বচন্দ্র আদালতে অভিযোগ করেন, এই কবিতায় তাঁর স্ত্রীকে নিয়েই কটাক্ষ করা হয়েছে। এমনকী, তিনি নিজে এবং তাঁদের পরিচিত সমাজের অন্য বিশিষ্ট জনেদের নিয়েও অনভিপ্রেত মন্তব্য করা হয়েছে। কালীপ্রসন্ন তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, “এ হল নির্মল হাস্যরস। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অসম্মানের উদ্দেশ্যে এ কবিতা লেখা হয়নি।” বিচারপতি জেনকিন্সকে বোঝাতে গোটা কবিতাটা ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়। হাইকোর্টের ১১ নম্বর এজলাসে ছ’মাস ধরে বিচার চলে। সুচিত্রা সেনের ‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবির আদালতের দৃশ্যে সেই এজলাসই দেখেছে বাঙালি। ১৮৯৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি জেনকিন্স কবিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তিনি বলেন, “কুৎসা এবং অসূয়াপ্রসূত বিবৃতির (scandalous and malicious libel) মাধ্যমে এই কবিতা নিশ্চিত ভাবে কুসুমকুমারীর সম্মানহানি করেছে।” মানহানির মামলায় তথা ৫০০ নম্বর দোষী সাব্যস্ত হলে দু’বছরের জেল কিংবা জরিমানার সাজা হতে পারে। কালীপ্রসন্ন জরিমানা দিয়েই রেহাই পেয়েছিলেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.