প্রশাসনের ‘মুখ পুড়েছে’। তাই কার্টুন-কাণ্ড থেকে ‘দূরত্ব’ রচনায় আপাতত সচেষ্ট প্রধান শাসকদল তৃণমূল।
সচেষ্ট স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা, রেলমন্ত্রী মুকুল রায় এবং প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে তৈরি রঙ্গচিত্র ই-মেলে বন্ধুবান্ধবদের ‘ফরওয়ার্ড’ করার দায়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের উপর দলীয় সমর্থকদের ‘হামলা’ এবং তার পর পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার পর শুক্রবার দিনভর রাজ্য জুড়ে যে ‘ব্যাড পাবলিসিটি’ (এই শব্দবন্ধ তৃণমূলেরই এক মন্ত্রীর ব্যবহৃত) হয়েছে, শনিবার সকাল থেকেই তা দ্রুত ‘মেরামতি’র কাজে নেমেছেন দলের প্রথম সারির নেতারা।
যে প্রচেষ্টার অন্যতম হল ঘটনা থেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ থাকা এবং দ্রুত কাউকে ‘কাঠগড়া’য় তুলে-দেওয়া। এ ক্ষেত্রে, কলকাতা পুলিশ।
ঘটনা যে ‘অন্য দিকে’ গড়াচ্ছে, তা বুঝতে পেরে শুক্রবারই দ্রুত ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ উদ্যোগী হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজেই। তৃণমূল সূত্রের দাবি, আদালতে যাতে পুলিশ ধৃত অধ্যাপকের জামিনের বিরোধিতা না-করে, শুক্রবারেই সেই নির্দেশ যায় মুখ্যমন্ত্রীর তরফে (তবে যে রঙ্গচিত্র পাঠানো হয়েছে, তাতে আর যা-ই হোক, ‘অশ্লীলতা’র অভিযোগ যে ধোপে টিকত না, তা-ও স্বীকার করে নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠরা)। পাশাপাশিই, অধ্যাপকের উপর হামলার ঘটনায় কারা জড়িত, তা খোঁজ নেওয়ার নির্দেশও দেন তিনি। শুক্রবার বেশি রাতে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক তাঁর উপর ‘নিগ্রহে’র অভিযোগে চার তৃণমূল কর্মীর নামে এফআইআর করার এক ঘণ্টার মধ্যে ‘তৎপরতা’ দেখিয়ে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতদের বিরুদ্ধে ওই অধ্যাপক মারধর, ভয় দেখানোর অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগে আরও বলা হয়েছিল, ওই চার জন ওই অধ্যাপককে প্রাণে মারার হুমকি দেয়। তাঁকে দিয়ে একটি কাগজে ‘জোর করে’ বয়ান লিখিয়ে নেয় এবং তিনি
যে আবাসনের বাসিন্দা, তার কয়েকটি লেটারহেডেও ‘জোর করে’ সই করিয়ে নেয়।
অরূপ মুখোপাধ্যায়, অমিত সর্দার (ঘটনাচক্রে, এই অমিতের অভিযোগের ভিত্তিতেই ওই অধ্যাপককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ), নিশিকান্ত ঘড়াই এবং শেখ মুস্তাফা নামে ওই চার জনকে এ দিন আদালতে হাজির করানো হয়। তারা সকলেই ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া পায় এবং ছাড়া পাওয়া মাত্রই কোর্ট লক-আপ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে উধাও হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে, ধৃত অধ্যাপক এবং তাঁর আবাসনের সম্পাদক যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে জামিন পেয়েছিলেন, অধ্যাপকের উপর নিগ্রহকারীরাও প্রত্যেকে সেই একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে জামিন পেয়েছে ৫০০ টাকা।
অবশ্য ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে ওই অভিযুক্তদের থেকেও এখন নিজেদের ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে চাইছে তৃণমূল। দলের এক মন্ত্রীর কথায়, “খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওদের সঙ্গে দলের কারও কোনও সম্পর্ক নেই। পরিবর্তনের পর তো এখন যে পারছে নিজেদের তৃণমূল বলে দাবি করছে!”
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এ দিন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, বিষয়টি তিনি জানতেনই না! ওই অধ্যাপককে গ্রেফতার করার আগে তাঁকে পুলিশ বিষয়টি সম্পর্কে আদৌ অবহিত করেনি। মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “আমরা তো ব্যাপারটা প্রথম জানতে পারি শুক্রবার দুপুরের পর!” ওই নেতার আরও দাবি, মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানান তাঁর সঙ্গে সফররত সাংবাদিকদের একাংশ। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দার সঙ্গে। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা হয় অন্যান্য মন্ত্রীরও। রাজ্য মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের দাবি, পচনন্দা তাঁকে জানান, অধ্যাপকের গ্রেফতারির বিষয়টি তিনি নিজেই নাকি জেনেছেন শুক্রবার বেলা ১১টা নাগাদ! জবাবে ওই মন্ত্রী পুলিশ কমিশনারকে বলেন, এ ভাবেই তা হলে পুলিশ-প্রশাসন চলছে! এমন একটি ‘স্পর্শকাতর’ ঘটনায় এক অধ্যাপককে পুলিশ গ্রেফতার করার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর তা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা জানতে পারছেন! যখন গোটা রাজ্য এমনকী, গোটা দেশেরও বিভিন্ন প্রান্ত বিষয়টি জেনে গিয়েছে!
পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে অবশ্য এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। সেলফোনে সাড়া মেলেনি।
তবে শাসক শিবিরেরই একাংশের মতে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে রঙ্গচিত্র পাঠানোর দায়ে এক জন অধ্যাপককে গ্রেফতার করা হচ্ছে অথচ মুখ্যমন্ত্রীকে সে সম্পর্কে জানানো হয়নি, সেটা কার্যত অসম্ভব। বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশে দফতরের ভারপ্রাপ্ত। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশও সেই ‘সম্ভাবনা’র কথা স্বীকার করছেন। তবে একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, পুলিশের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে ‘অশালীন’ ছবি ই-মেল করা হয়েছে (ওই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বৈদ্যুতিন মাধ্যম দিয়ে অশ্লীল ছবি পাঠানোর অভিযোগও এনেছিল পুলিশ)। তাই মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপকের গ্রেফতারির মধ্যে ‘অন্যায়’ কিছু দেখেননি। বস্তুত, দুর্গাপুরের সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি ওই গ্রেফতারির পক্ষে প্রকাশ্যেই ‘সরব’ হন। মঞ্চ থেকেই মমতা বলেন, “অন্যায় করবে, আবার অ্যারেস্ট হলে তাই নিয়ে প্রচার করবে! অন্যায় করে, অশ্লীলতা করে উন্নয়ন থমকে দিতে চাইছে। চক্রান্তকারীদের মানুষ ক্ষমা করবে না।”
রাজ্যের এক মন্ত্রীর আপাতত বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীকে পুলিশের তরফে যা জানানো হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই তিনি ‘অশ্লীলতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু যে রঙ্গচিত্র নিয়ে এত কাণ্ড, তার মধ্যে আর যা-ই হোক, ‘অশ্লীলতা’ খুঁজে পাওয়া কঠিন!” ওই মন্ত্রীর ক্ষোভ, “শুধু শুধু মুখ পুড়ল! এর কোনও দরকারই ছিল না!”
বস্তুত, তৃণমূল নেতৃত্বের এখন বক্তব্য, ‘অশ্লীল’ ছবি পাঠানোর ধারা প্রয়োগ করেও পুলিশ ‘অবিমৃষ্যকারিতা’ করেছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “পুলিশ গোটা ঘটনাটাতেই অত্যন্ত ছেলেমানুষির পরিচয় দিয়েছে। ন্যূনতম সতর্কতা দেখানো হয়নি! এমন অভিযোগ আনারই বা কী দরকার ছিল, যা আদালতে টিকবে না!”
অবস্থা আরও ‘জটিল’ করেন রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য পূর্ণেন্দু বসু। অধ্যাপক-গ্রেফতারের ঘটনায় যখন গোটা রাজ্য মুখর, সর্বভারতীয় নিউজ-চ্যানেল ‘আলোড়িত’, তখন মহাকরণে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “পুলিশ যা করেছে, ঠিক করেছে!” তাঁর সতীর্থ এক মন্ত্রীর বক্তব্য, “ভাল করে খোঁজখবর না-নিয়ে ও সব বলার কী প্রয়োজন ছিল?” শ্রমমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র অবশ্য এ দিন জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘অনুমোদন’ (আসলে ‘নির্দেশ) ছাড়া তিনি প্রকাশ্যে ওই বক্তব্য পেশ করেননি।
ঘটনাচক্রে, তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানায় প্রথম বাংলা নববর্ষে রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানাতে আধুনিক প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। এ দিন সকাল থেকেই রাজ্যের অসংখ্য সেলফোন-গ্রাহকের নম্বরে রাজ্য সরকারের তরফে শুভেচ্ছাবার্তা গিয়েছে। যার তলায় ‘মমতা’ নামটি লেখা। একাধিক নম্বর থেকে গ্রাহকদের সেলফোনে ফোন এসেছে। ফোন ধরলে স্বয়ং মমতার গলায় শোনা যাচ্ছে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা। অন্য সময় হলে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই ‘অন্যরকম’ প্রতিক্রিয়া হত রাজ্যবাসীর। রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসকের তরফে ‘ব্যক্তিগত’ বার্তা পাঠিয়ে মমতা নিজেও সেই ‘চমক’ দিতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে তাঁর সেই প্রয়াস নিয়েও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ‘বিরূপ’ মতামত প্রকাশ করেছে নেট-জনতার বড় অংশ। মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে বার্তাও রয়েছে (যেমন, ‘৩৪ বছরে এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর তরফে শুভেচ্ছা এসএমএস পেলাম’ ইত্যাদি)। কিন্তু অধিকাংশই মুখর তাঁদের ‘ব্যক্তিগত’ নম্বরে ফোন এবং এসএমএস আসার বিষয়ে ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করে।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কানেও বিষয়টি পৌঁছেছে। এ দিন তিনি অধিকাংশ সময় বাড়িতেই কাটিয়েছেন। তাঁর সেলফোনে পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তার জবাব দিয়েছেন। প্রত্যাশিত ভাবেই কার্টুন-কাণ্ড নিয়ে প্রকাশে কোনও মন্তব্য করার পথে যাননি। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে ‘অনুযোগ’ করেছেন, বাংলা বছরের শেষ দিনে যে ‘উন্নয়নের কর্মসূচি’ তিনি নিয়েছিলেন, বছরের প্রথম দিনে তা পিছনে চলে গিয়ে প্রচারে চলে এল নিতান্তই ‘অকিঞ্চিৎকর’ একটি বিষয়। তা-ও তাঁর ‘অজান্তে’!
সরকারের বর্ষপূর্তির বাকি এক মাসের সামান্য বেশি। আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইতিবাচক’ প্রচার প্রয়োজন ছিল। মন্ত্রিসভায় তাঁর সতীর্থরা ‘হতাশ’। কারণ তাঁরা জানেন, যে বা যারাই ‘অদক্ষতা’র পরিচয় দিয়ে থাকুক, প্রশাসক হিসেবে তার ‘দায়’ মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকারের উপরেই এসে পড়ে। সে যতই দলের অন্দরে এবং ঘনিষ্ঠ মহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং শাসক দলের তরফে ‘দূরত্ব’ তৈরির মরিয়া চেষ্টা হোক! |