সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৪ সালে এক নির্দেশে বলেছিল, অভিযোগ করা মাত্রই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা পুলিশের সঠিক পদক্ষেপ নয়। বরং আইনের পরিপন্থী। ২০০৮-এ অন্য একটি মামলাতেও প্রায় একই রায় দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলে, এফআইআর দায়ের হলেই দ্রুত অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা ঠিক নয়।
তবু সেটাই ঘটে। যেমন ঘটেছে নেট-রঙ্গ কাণ্ডে অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে।
রাজ্য প্রশাসন ও বিরোধী পক্ষের একাংশের বক্তব্য, পুলিশের এখন একটা ‘অভিযোগ-পত্র’ পেলেই হল। অনেক ক্ষেত্রেই সেই অভিযোগের পিছনে থাকে কোনও ‘বড় মহলের’ (পড়ুন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল) প্রশ্রয় বা প্ররোচনা। তাদের ‘উদ্যোগে’ই ‘প্রতিপক্ষ’কে চাপে রাখতে সামান্য ঘটনাতেও নির্বিচারে এফআইআর দায়ের করানো হয়। পুলিশও এই সব ক্ষেত্রে এফআইআর নেওয়ার ব্যাপারে বাছবিচার করে না। তার পর তদন্ত ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে উঠেপড়ে লাগে। এ ভাবেই এফআইআর দায়ের এবং তার পর বিনা তদন্তে গ্রেফতার করা এক অর্থে পুলিশ ও ক্ষমতাশালী রাজনীতিকদের একটা ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে বলে তাদের অভিযোগ। |
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশের একটি অংশের দাবি, আইন তার নিজের পথেই চলে। কিন্তু যে অভিযোগ-পত্রের জেরে অম্বিকেশবাবুকে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে গ্রেফতার করেছিল পূর্ব যাদবপুর থানার পুলিশ, কীসের ভিত্তিতে তা ‘এফআইআর’ হিসেবে গণ্য হল, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য প্রশাসন এমনকী পুলিশেরই অনেকে। পুলিশি নথি বলছে, অমিত সর্দার নামে তৃণমূলের চকবেড়িয়া ছিটনয়াবাদ আঞ্চলিক কমিটির এক সদস্য থানায় লিখিত অভিযোগ করে বলে, গত ২২ মার্চ অম্বিকেশবাবু ও তাঁর এক প্রতিবেশী আবাসনের ই-মেলে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে অসম্মানজনক মেসেজ পাঠান। তাঁরা আবাসনের সদস্যদের বাড়িতে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নামে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ ও চরিত্র হনন করছেন।
এখন একাধিক শীর্ষস্থানীয় পুলিশকর্তার প্রশ্ন, অধ্যাপকের ই-মেল মুখ্যমন্ত্রীর মানহানি ঘটিয়েছে, যেখানে এটাই ছিল ওই অভিযোগের মূল কথা, সেখানে পুলিশ কেন অভিযোগকারীকে বলেনি যে এই ধরনের অভিযোগের (নন-কগনিজেবল) ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ ছাড়া তদন্ত শুরু করার অধিকার তাদের নেই।
মহাকরণের একটি অংশ আবার বলছে, গোটা ঘটনাটা ‘সাইবার অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং সেই সংক্রান্ত আইন মোতাবেকই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাদের বক্তব্য, ইন্টারনেটে সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ সম্পর্কে ‘কুরুচিকর’ প্রচার ঠেকাতে কপিল সিব্বল যদি কড়া আইন করার কথা বলতে পারেন, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওই একই রকম প্রচার ঠেকাতে রাজ্য কঠোর হবে না কেন। পুলিশ কেন গোড়া থেকেই ‘সাইবার অপরাধ’
|
অম্বিকেশ মহাপাত্র |
আইনে এই উস্কানিমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেই প্রশ্নও তাঁরা তুলেছেন। বস্তুত, বিরোধীদের দাবি মতো অম্বিকেশবাবুর পাঠানো ই-মেলটিকে ব্যঙ্গচিত্র বলে মানতেও নারাজ মহাকরণের ওই অংশটি। তাদের বক্তব্য, ব্যঙ্গচিত্র হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছবি অন্য রকম ভাবে আঁকতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফটোগ্রাফের পাশে দীনেশ ত্রিবেদীকে ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার কথা লেখা হয়েছে। যা মহাকরণের ওই অংশের মতে, প্রচ্ছন্ন ভাবে হিংসা ছড়ানোর উস্কানি দেওয়ার সমান।
রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ই-মেল পাঠানোর ঘটনা তো ঘটেছিল ২১ দিন আগে ঘটেছিল। তা হলে তার এফআইআর এত দেরিতে হল কেন? আর হলই যদি, তা হলে পুলিশ কার্যত কোনও তদন্ত ছাড়াই অভিযোগ-পত্রের ভিত্তিতে অধ্যাপককে চটজলদি গ্রেফতার করল কেন? পুলিশ অম্বিকেশবাবুর আবাসনের কোনও বাসিন্দার বাড়িতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের ‘সত্যতা’ যাচাই করেছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
অন্য দিকে অম্বিকেশবাবুর অভিযোগ, জোর করে থানায় নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে মারধর করা হয়। সে কথা তিনি ওই রাতেই পুলিশকে জানিয়েছিলেন। একাধিক পুলিশকর্তার প্রশ্ন, থানার অফিসারেরা কি তাঁকে ওই অভিযোগ নথিভুক্ত করার জন্য কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়েছিলেন? পূর্ব যাদবপুর থানার বক্তব্য, অম্বিকেশবাবুর দেহে ‘সামান্য আঘাত’-এর চিহ্ন ছিল। তাই ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়নি। যার উত্তরে পুলিশের একাংশ বলছে, বাইরে থেকে আঘাতের মাত্রা বোঝা গেল কী ভাবে? তাঁর কোনও ‘ইন্টারনাল ইনজুরি’ যে হয়নি, সে ব্যাপারে থানা কী ভাবে নিশ্চিত হয়েছিল?
ওই রাতে পূর্ব যাদবপুর থানার পুলিশ তদন্ত-নীতির ন্যূনতম ব্যাকরণ মানেনি বলে অভিযোগ উঠেছে পুলিশ মহলেই। এক পুলিশকর্তা বলেন, “অভিযোগ জমা পড়লে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই তথ্য অনেক সময় তদন্তের অভিমুখ ঠিক করে দেয়।” কিন্তু বাস্তবে তা হয় না বলেই রাজ্যের থানাগুলিতে যত অভিযোগ দায়ের হয়, তার মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তের শাস্তি হয়। সাধারণ মানুষকে সুবিচার দিতে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, প্রতি থানায় পুলিশের পৃথক তদন্তকারী দল থাকা উচিত। নিত্যদিনের আইনশৃঙ্খলার কাজে তাদের লাগানো উচিত নয়। কিন্তু এই রাজ্যে তা এখনও হয়নি।
রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তার বক্তব্য, তদন্তের প্রয়োজনেই গ্রেফতার করার কথা বলা আছে পুলিশ-বিধিতে। এফআইআর হলেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই। অনেক সময় হাতে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তকে গ্রেফতার না করাই বিধেয়। তবে, কোনও ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার যদি মনে করেন অভিযুক্তকে ছেড়ে রাখলে তদন্ত ব্যাহত হবে, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই তিনি তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেন। আর এই ‘সুযোগ’টাই কাজে লাগিয়ে বহু ক্ষেত্রেই এফআইআর করা মাত্রই গ্রেফতারের রাস্তায় পুলিশ হাঁটছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশি তদন্তই বলছে, ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার রাত ৮টা নাগাদ। অম্বিকেশবাবু যে আবাসনের বাসিন্দা, সেই সমবায়ের চেয়ারম্যান নেপালশঙ্কর চৌধুরী বলেন, “রাত ৮টা নাগাদ অরূপ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি সমবায়ের অফিসে এসে জামার পকেট থেকে একটি কাগজ বার করে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ই-মেল পাঠিয়েছিলেন তো, এ বার তার ফল দেখাব।’ তার পরে সে ফোন করে অম্বিকেশবাবুকে অফিসে ধরে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেয়।” চেয়ারম্যান জানান, কিছু ক্ষণ পরে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিসে ঢোকানো হয় অধ্যাপককে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে ওই যুবকেরা। ব্যঙ্গ-মেলটির একটি কপি বার করে অরূপবাবু অধ্যাপককে বলেন, ‘অনেক বাড়াবাড়ি করেছিস। এ বার শ্রীঘরে ঢোক।’’
পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে অম্বিকেশবাবু লিখেছেন, সমবায়ের চেয়ারম্যান, সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের সামনে তাঁকে প্রাণে মারার হুমকি দেয় তৃণমূল নেতা অরূপ মুখোপাধ্যায় ও অমিত সর্দার। এফআইআর-এ তাঁর অভিযোগ, “দুষ্কৃতীরা বলে, ‘...খুব বেড়েছিস। মেসেজ করা? প্রাণে মেরে দেব।’ এই বলে আমাকে চেয়ার তুলে মারতে যায় ওরা। কিল, চড়, ঘুষিও মারে।” অধ্যাপকের অভিযোগ, তাঁকে দিয়ে ‘জোর করে’ কো-অপারেটিভের লেটারহেডে ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ ওদের বয়ান অনুযায়ী মুচলেকা লিখতে বাধ্য করা হয়। এবং সমবায়ের কয়েকটি ফাঁকা লেটারহেডেও জোর করে সই করিয়ে নেয় তারা। অধ্যাপক লিখেছেন, “এমন সময় কয়েক জন পুলিশ আসে এবং আমাকে থানায় নিয়ে যায়।”
এই এফআইআর-এর ভিত্তিতেই শনিবার সকালে চার জনকে গ্রেফতার করে সেই পূর্ব যাদবপুর থানার পুলিশ। ওই চার জনের মধ্যেই রয়েছে অমিত সর্দার, যার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অম্বিকেশবাবু। |