ওডাফা দেখবি মাঠে থাকলে একটা না একটা গোল করবেই!
একটা বিদেশি ডিফেন্ডার নেই আমাদের। র্যান্টিকে আটকাতে পারবে?
ডেম্পোরই বা বিদেশি ডিফেন্ডার কই? পাশে ব্যারেটো থাকায় গোলের পাস ওডাফা পাবেই।
র্যান্টির পিছনে অনেক ভাল মাঝমাঠ। ও কিন্তু অনেক বেশি বল পাবে।
মোহনবাগান তাঁবুর সামনে ছোট জটলায়, কচি থেকে বৃদ্ধ। সেখানেই এ সব আলোচনা। যেন রবিবারে মোহনবাগান বনাম ডেম্পো ম্যাচ নেই। অন্য ম্যাচ--ওডাফা বনাম র্যান্টি।
দু’জনের ফারাকটা কী? তৃতীয় নাইজিরিয়ান বার্নার্ড ওপারানোজি, মোহনবাগান ম্যানেজার বলে গেলেন, “একজন একাই গোল করতে পারে। অন্য জনের গোল করতে সাহায্য লাগে।” কে কোন জন, স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে?
শুধু আই লিগেই ওডাফার গোল ১৩৪। র্যান্টির ১৩৯। সব মিলিয়ে গোলসংখ্যা দুশো ছাপিয়ে গেছে বহু আগেই। গুণের বহর প্রচুর।
ওকোলি ওডাফা: শুটিং দারুণ। শূন্য থেকে রাতারাতি গোল বানাতে ওস্তাদ। ছোট জায়গার মধ্যে টার্নিং অসাধারণ। তিন-চার জনকে ডজ করা কিছুই নয়। ছোট বক্সে বিপজ্জনক। মূলত অ্যাটাকিং থার্ডেই খেলেন।
র্যান্টি মার্টিন্স: শুটিংয়ের মতো হেডিংও ভাল। অন্যদের সঙ্গে পাস খেলে বক্সে উঠতে পারেন। অনেকটা জায়গা নিয়ে, নেমে উঠে খেলেন। কখনও খেলা থেকে হারিয়ে যান না। টিম গেমের পক্ষে আদর্শ।
দশের মধ্যে এই দু’জনকে আপনি কত দেবেন? সাম্প্রতিক কালের দুই সফল ভারতীয় ফরোয়ার্ডকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল। দু’জনেই এক উত্তর দিলেন। দীপেন্দু বিশ্বাস ও অ্যালভিটো ডি’কুনহা, দু’জনের কাছেই ওডাফা ১০-এ ৮, র্যান্টি ৭। দীপেন্দুর পযর্বেক্ষণ একটু অন্য রকম, “ভারতীয় ফুটবলের মানে ওডাফা এগিয়ে। পরিশ্রমের জন্য বাইরের ফুটবলের প্রেক্ষাপটে র্যান্টি।” |
এই দুই নাইজিরিয়ানের সঙ্গে যোগ করতে পারেন দুটি নির্ভেজাল ভারতীয় মুখ। আজ ম্যাচটার ভাগ্য বিধাতা তাঁরাও।
সুব্রত ভট্টাচার্য প্র্যাক্টিসে নামার আগে সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলছিলেন। নবি থেকে ওডাফা। আর আর্মান্দো কোলাসোর মুখে শোনা গেল, রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনার কথা। লা লিগায় একটা সময় রিয়াল ১০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৬। আর্মান্দোর কথায় স্পষ্ট, তিনি রিয়াল মাদ্রিদ হতে চান না। ৮ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার আত্মতৃপ্তিকে ফ্রি কিকে ওড়াতে চান ডেম্পো কোচ।
আর্মান্দো ও সুব্রতর মধ্যে মিল আর ফারাকটা কোথায়?
মিল: দেশের ফুটবলারদের তাতাতে বড় ভূমিকা নেন। আর্মান্দো দু’দিন আগেই বলছিলেন, “একটা দলে দুটোর বেশি বিদেশি খেলানো উচিত নয়।” স্বদেশিদের প্রবক্তা আর্মান্দোর প্রথম দলে দুই বঙ্গসন্তানশুভাশিস রায়চৌধুরী, দেবব্রত রায়। সুব্রতর মতো আর্মান্দোও বিতর্কিত কথা বলতে ভয় পান না। দু’জনেই ম্যাচ চলাকালীন ভাল স্ট্র্যাটেজি নিতে ওস্তাদ। আবার মুডি। আর্মান্দো যেমন এ দিন মোহনবাগান মাঠে প্র্যাক্টিস করাবেন না বলে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেছিলেন সল্টলেক সাইতে। নানা নাটক করে।
অমিল: টিম চালানোর ক্ষেত্রে আর্মান্দোর সুবিধা অনেক। তিনিই সচিব। তাঁর কথাই আসল। তিনি চাইলে কোচ থেকে যেতে পারেন অনেক দিন। ক্লাবে সুব্রতর সেই ক্ষমতা নেই। বরং কিছু কর্তা ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন।
আর্মান্দো এবং সুব্রত দু’জনেই এ বার চার বিদেশির সুবিধা নিতে পারেননি। বিদেশি বাছাইয়ে দুই ক্লাবের কর্তারাই ব্যর্থ। রবিবার তবু আর্মান্দোর এগারোয় তিন বিদেশি র্যান্টি, কোকো সাবিকো ও ত্রিনিদাদের ডেনসিল থিওবাল্ড। বাইরে জাপানি ইউসুকে কাটো।
সুব্রত প্রথমে ভেবেছিলেন, তাঁর তিন বিদেশিকেই নামিয়ে দেবেন। শনিবার প্র্যাক্টিসে হাদসন লিমার ফিটনেস দেখে মোহনবাগান কোচ দ্বিধায়। চোট থেকে ওঠা দুই ব্রাজিলিয়ানকে খেলানো ঠিক হবে কি না। প্র্যাক্টিস ম্যাচে তাঁর প্রথম দলের মাঝমাঠে ছিলেন জুয়েল, রাকেশ, হাদসন। পরে দেখা গেল, হাদসনের বদলে এলেন মণীশ মৈথানি। সম্ভবত ম্যাচেও এটাই দাঁড়াবে, কেননা হাদসন পরে নামতে চাইছেন। ৪-৩-৩ ছকে সামনে ব্যারেটো-ওডাফা। একটু পিছনে সুনীল ছেত্রী। প্র্যাক্টিসে রাকেশ মাসির মাথা ফেটে চারটি সেলাই পড়ল। তবু তিনি খেলতে মরিয়া, যা থেকে ফুটে উঠছে মোহনবাগানের মরিয়া মেজাজ। হারলেই তাদের সব স্বপ্ন ধুলোয়। এবং সুব্রত বলছেন, “মাঝমাঠ যার, ম্যাচও তার।”
মাঝমাঠ নিয়ে আর্মান্দোও কি পুরোপুরি স্বস্তিতে? আজ্ঞে না। ক্লাইম্যাক্স লরেন্সের পরেই ডেম্পোর সবচেয়ে চেনা নাম, ক্লিফোর্ড মিরান্দা ফর্মে নেই। আর্মান্দোর মাঝমাঠে ক্লাইম্যাক্স-ডেনসিল ছাড়া থাকছেন পিটার কার্ভালহো, অ্যান্টনি পেরিরা। প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, দেশের সেরা পাসার এখন ক্লাইম্যাক্স। বাকিরা জুজু নয়। সুব্রত-প্রশান্তর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা ক্লাইম্যাক্সের সঙ্গে র্যান্টির যোগাযোগের ঘুড়ি ভো-কাট্টা করতে চান। আর্মান্দো যেমন চান, ওডাফাকে জোনাল মার্কিংয়ে আটকাতে।
ওডাফা-র্যান্টি নিয়ে চর্চার ফাঁকে অন্তরালের সূর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আর এক বিদেশি। রবিবাজারের ফুটবল যুদ্ধে পঞ্চম চরিত্র। এই ম্যাচই নাকি তৈরি করে দেবে আই লিগের রং। অতটা নিশ্চিত নই। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, এই ম্যাচ ঠিক করে দেবে হোসে রামিরেজ ব্যারেটোর ভাগ্য। যিনি সাংবাদিকদের সামনে এসে বলছিলেন, “ম্যাচটা খেলার জন্য আমরা সবাই উত্তেজিত।”
মোহনবাগানে পরের মরসুমের ভাবনায় এত দিনের ‘শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার ভরসা’ ব্যারেটো এতটাই ব্রাত্য, ছ্যাঁৎ করে মনে হবে, এটাই সবুজ মেরুন তাঁবুতে তাঁর শেষ সাংবাদিক সম্মেলন নয় তো? পরের মরসুমে ওডাফা-ব্যারেটোর হাউসিং কমপ্লেক্সেই ‘প্রয়াগ’এর র্যান্টির থাকার কথা। ব্যারেটো সেখানে থাকবেন আদৌ? সুব্রতর কোচিংয়ে তাঁর উদয়, সুব্রতর কোচিংয়েই কি অস্ত? কে জানে! সুব্রত নিজের বিশ্লেষণ, “ফিট থাকলে ব্যারেটো আরও দু’তিন বছর হেসেখেলে খেলবে।” শিশির ঘোষ এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, “ওডাফা বা র্যান্টি নয়, রবিবারের ম্যাচটা ব্যারেটোরই হতে পারে। ফিট থাকলে এটাই ওর উঠে দাঁড়ানোর মঞ্চ। সচিন যেমন হারিয়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়িয়েছিল।”
এ শহর ছেড়ে যেতে মন চায় না। এ শহর ভালবেসে ফেলেছে তাঁর স্ত্রী সন্তান। তাই মোহনবাগান ছেড়ে দিলেও গোয়ায় খেলতে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত নেই ব্যারেটোর। “এই ম্যাচে খেলতে পারলে বুঝতে পারব, আর চালানো যাবে কি না। না পারলে হয়তো অবসরই নিতে হবে। আমার জন্য আমাকে ভাল খেলতে হবে। নব্বই মিনিট মাঠে থাকতে হবে।” গাড়িতে ওঠার সময় বলছিলেন ব্যারেটো। দু’চারটি কচি মুখ তাঁর ছবি তোলা, সই নেওয়ার চেষ্টায়। টিভি চ্যানেলের বুম নেই। ব্যারেটোর পাশে শূন্যতা নেমে এসেছে হঠাৎই।
র্যান্টি-ওডাফার টেকনিক্যালি পার্থক্য কোথায়? আজ এই জাতীয় প্রশ্ন করারই দিন। ব্যারেটো স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বললেন, “ওডাফার শুটিং দারুণ। ব্যক্তিগত দক্ষতা অসাধারণ। র্যান্টি আবার স্কিলের ওপর জোর দেয়।” বলতে বলতেই কিছুটা অন্যমনস্ক, “ম্যাচটা জিততেই হবে আমাদের।”
ফুটবল-নাটকের বাকি চার চরিত্রও নিশ্চয়ই মনে মনে ওই একই কথা বলছেন! |