সার্বিক ‘অচলাবস্থা’ কাটাতে আর্থিক ক্ষেত্রে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ নতুন নয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে।
বস্তুত, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই এই জেলা পরিষদে উন্নয়নের কাজ থমকে পড়ে। লোকসভা-বিধানসভা ভোটের পরে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, স্থায়ী সমিতি ও সাধারণ সভায় বামেরা ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে পড়াতেই এই বিপত্তি। সাধারণ সভায় পাস হওয়ার পরেও জেলা সভাধিপতি অনুমোদন দিতে না চাওয়ায় কয়েকটি ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। সে সবের প্রেক্ষিতে কয়েকটি আর্থিক বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। পঞ্চায়েত আইন মেনেই তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অলোকেশপ্রসাদ রায়।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, সাধারণ সভায় পাস হওয়ার পরেও কিছু ক্ষেত্রে জেলা সভাধিপতি সেই ফাইলে সই করছিলেন না। সে সব ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত আইন মোতাবেক হস্তক্ষেপ করেন জেলাশাসক। যেমন, তৃতীয় ও ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের রাস্তা সংস্কার ও পানীয় জল বাবদ মোট ১১ কোটি টাকা ব্যবহার হচ্ছিল না। সম্প্রতি জেলাশাসক ওই টাকা ব্যবহারের অনুমোদন দেন। গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নের ৭০ কোটি টাকাও আটকেছিল দীর্ঘ দিন ধরে। শেষে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে চলতি বছরের ২১ মার্চ তা পাওয়া গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনায় ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা হওয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রাথমিক ভাবে ৩৮ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওই টাকা খরচ করা যাচ্ছিল না। টাকা ফেরত যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় এ ক্ষেত্রেও জেলা প্রশাসন সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, “যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে জেলা পরিষদের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে আলোচনা করছি। সমস্যা সমাধানে নজর দেওয়া হচ্ছে।”
কিন্তু কেন এই অবস্থা? |
এই জেলা পরিষদে আসন ৫১টি। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৭টি। ২৪টি ছিল বামবিরোধীদের দখলে। পরবর্তী সময়ে নানা কারণে দু’পক্ষের ১ জন করে সদস্য কমে। স্থায়ী সমিতি কিংবা সাধারণ সভার কার্যকলাপ চালাতে গিয়ে প্রথম থেকেই বেগ পেতে হয়েছে বামেদের। কারণ, জেলা পরিষদের সদস্য বাদেও স্থায়ী সমিতিতে ভোটাধিকার আছে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সাংসদ-বিধায়কদের (যাঁরা কেন্দ্রে বা রাজ্যে মন্ত্রী নন)। পঞ্চায়েত ভোটে এই জেলায় ২২টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ১৮টি পেয়েছিল বামবিরোধীরা। ৪টি যায় বামেদের দখলে। পরবর্তী সময়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে একটি পঞ্চায়েত সমিতি চলে আসে বামবিরোধীদের হাতে। অর্থাৎ, স্থায়ী সমিতিতে শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বামবিরোধীদের। লোকসভা ভোটের পরে স্থায়ী সমিতিতে আরও ৪ সাংসদের ভোট বেড়েছে তৃণমূলের। বিধানসভা ভোটে আসন সংখ্যা বাড়ে আরও ১৪টি।
এই পরিস্থিতিতে বছর দেড়েক আগে তৃণমূল দাবি করে, জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই মতো পৃথক ‘ডেভেলপমেন্ট সাব কমিটি’ তৈরি করে তারা। স্থায়ী সমিতি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় বামেরা। স্থায়ী সমিতি ভাঙার সিদ্ধান্তের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করে আদালত।
গত তিন বছরে মাত্র তিন বার সাধারণ সভা ডেকেছেন সভাধিপতি (সাধারণ সভা ডাকার কথা প্রতি তিন মাস ছাড়া)। ডেভেলপমেন্ট সাব কমিটি আবার যে বিকল্প উন্নয়ন-প্রস্তাব পেশ করেছে সাধারণ সভায়, তা অনেক ক্ষেত্রে পাস করানো যায়নি।
এ ক্ষেত্রে আবার তৃণমূলের ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ই এর কারণ। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, ডেভেলপমেন্ট সাব কমিটি তো তৃণমূলের। সাধারণ সভাতেও তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নিজেদের মধ্যে কোন্দলের জেরেই ওরা প্রস্তাব পাস করাতে পারেনি। জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা তৃণমূলের আবদুল রউফ মণ্ডল বলেন, “সাধারণ সভা নিয়মিত ডাকাই হয়নি। তারপর তো প্রস্তাব পাস করানোর কথা। বামেরা নিজেদের ব্যর্থতা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।”
সামগ্রিক ভাবেই ২০০৮ সালের পর থেকে জেলা পরিষদের বেশিভাগ উন্নয়নের কাজই থমকে ছিল। জেলা পরিষদের সভাধিপতি ভরত দাসও নিয়মিত কার্যালয়ে আসেন না বলে অভিযোগ। কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ সভায় পাস হওয়া প্রস্তাবেও তিনি সই করেননি বলে অভিযোগ। মাস কয়েক আগে জেলা সদর বারাসতে এসে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলা পরিষদের সার্বিক অচলাবস্থা নিয়ে প্রশাসনের তরফে তাঁর কাছে অভিযোগ জানানো হয়। দলের অন্দরে একাধিক গোষ্ঠীর বিবাদে জেলা পরিষদের কাজে সমস্যা হচ্ছে, সে কথাও মুখ্যমন্ত্রীর কানে ওঠে। সমস্যা মেটাতে পদক্ষেপ করা হবে বলে তখনই মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রউফ এ দিন বলেন, “সঠিক সিদ্ধান্ত। এই পদক্ষেপ আগেই করা দরকার ছিল।”
যদিও স্থানীয় বাম নেতৃত্বের একাংশের মতে, সরকারের এই পদক্ষেপ পরোক্ষে তাদেরই সুবিধা করে দিল। জেলা পরিষদে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে বামেদের ‘মুখরক্ষা’ দায় হয়ে উঠেছিল। এ বার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে ‘স্বৈরতন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে আখেরে পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলকেই ‘চাঙ্গা’ করা যাবে।
পূর্বঘোষণা মতোই মঙ্গলবার দুপুরে জেলাশাসকের অফিসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন উত্তর ২৪ পরগনার বাম নেতৃত্ব। হাজির ছিলেন সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী, অমিতাভ বসু, তড়িৎ তোপদার প্রমুখ। পরে জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দেন তাঁরা। অমিতাভ নন্দী বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছি আমরা। অবিলম্বে এই নির্দেশ প্রত্যাহার করতে হবে।” সরকারি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন বাম নেতারা। |