রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আনীত একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করিয়া ভারত ভোট দিয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনীত এই প্রস্তাবটি শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের শেষ লগ্নে অসামরিক তামিলদের উপর গণহত্যা ও গণধর্ষণের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বাসভূমি হইতে উচ্ছেদ তামিল শরণার্থীদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত। এই দুইটি ক্ষেত্রেই যে প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ রহিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। গত দুই বছর ধরিয়া কিন্তু ভারত সরকার এ জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারের উপর কোনও চাপ সৃষ্টি করে নাই। একটি দীর্ঘ দিনের মিত্র রাষ্ট্রকেও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে যে পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল, তাহাও দেয় নাই। স্বভাবতই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাবে ভোটাভুটিতে ভারতের শ্রীলঙ্কা-বিরোধী অবস্থান অনেকের কাছেই ‘অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক’ ঠেকিয়াছে। একটি উচিত কাজও অনৌচিত্যের অগৌরব প্রাপ্ত হইতেছে।
ইহার কারণ আর কিছুই নয়, যে ভাবে সরকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে, তাহার পদ্ধতিটি প্রশ্নাতীত নয়। প্রথমে সরকার জানাইয়া দেয়, কোনও বিশেষ দেশের নাম করিয়া তাহার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রস্তাব পাশ করা ভারতের নীতি নয়। অথচ কার্যক্ষেত্রে ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। সরকার আপন সিদ্ধান্ত অবশ্যই পাল্টাইতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাল্টাইবার কারণটি স্পষ্টতই তামিলনাড়ুর রাজনীতি। সংসদে তামিল সাংসদদের তীব্র শ্রীলঙ্কা-বিরোধিতা এবং শরিক দল ডি এম কে ও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতার প্রবল চাপের মুখেই সরকার নীতি পরিবর্তন করে। অর্থাৎ অঙ্গরাজ্যের চাহিদা এবং জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা দ্বারাই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি নির্ধারিত হইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশ নীতি নির্ধারণেও রাজ্যের অভিমত শোনা এবং বিবেচনা করা কেন্দ্রের কর্তব্য, বিশেষত যেখানে সেই নীতির পরিণাম রাজ্যের উপরেও বর্তায়। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, রাজ্য ও কেন্দ্রের সম্পর্কের প্রশ্ন। তাহার অর্থ এই নয় যে, জোট বজায় রাখিবার তাগিদে শরিক দলের চাপে পড়িয়া বিদেশ নীতির নির্ধারণ বা পরিবর্তন সাধিত হইবে। শ্রীলঙ্কা সেনার নির্বিচার দমননীতি এবং শরণার্থী তামিলদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সরকারি কার্পণ্যের প্রতি বরাবর নীরব ও ক্ষমাশীল থাকিয়া আজ সহসা তামিল রাজনীতির বিস্ফোরণ ঠেকাইতে শ্রীলঙ্কা-নিন্দায় শামিল হওয়াটা দৃষ্টিকটু বইকী।
সত্য, ভোটাভুটির আগে নিন্দা-প্রস্তাবটিকে সহনীয় করিতে ভারত সংশোধনী পাশ করাইয়াছে। এই প্রস্তাবের অজুহাতে বাহিরের কোনও শক্তি যাহাতে শ্রীলঙ্কায় সামরিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করিতে না-পারে, তাহাও নিশ্চিত করিয়াছে, ঠিক যেমন সিরিয়ার বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবেও করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে শ্রীলঙ্কার সরকারকে ভারত-বিরোধিতার পথ হইতে সরাইয়া আনা যাইবে বলিয়া মনে হয় না। ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা কাশ্মীর প্রসঙ্গ টানিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জে তাহার উপরও ভবিষ্যতে নিন্দা-প্রস্তাব উঠিবার কথা বলিয়া নয়াদিল্লিকে চাপে রাখিতে চাহিয়াছে। তদুপরি চিনের বর্ধমান অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও রাজনৈতিক প্রভাবে পুষ্ট কলম্বো শাসক রাজাপক্ষে পরিবারের অনুকূলে এবং তামিলদের বিপক্ষে দেশময় যে উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের জিগির পরিকল্পিত ভাবে জাগাইয়া চলিয়াছে, ভারত-বিরোধী নানা স্লোগানও তাহাতে শামিল। নিছক দৃঢ়তা ও কল্পনাশক্তির অভাবে ভারত তাহার দীর্ঘ দিনের উপমহাদেশীয় মিত্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের কাছে হারাইতে চলিয়াছে কি না, এখনই তাহা বলার সময় আসে নাই। তবে তাহার লক্ষণগুলি ক্রমশ স্ফুট হইতেছে। |