ভাগ্যিস এসপ্ল্যানেড, শোভাবাজার বা রবীন্দ্র সদনে ‘চাক্কা-জ্যাম’ হয়নি মেট্রোর। সোমবার গিরিশ পার্কের বদলে সে সব স্টেশনের একটিতে এমন ঘটলে পরিষেবা স্বাভাবিক করতে হয়তো আরও হিমশিম খেতেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ! কারণ, গত ২৮ বছরে এ রকম পরিস্থিতিতে যে আগে পড়তে হয়নি ওই সংস্থাকে।
গিরিশ পার্কে এ দিন দুপুরে একটি রেকের ‘অচেনা’ যান্ত্রিক ত্রুটির প্রেক্ষিতে তাই বাড়তি চিন্তিত মেট্রোকর্তারা। তাঁরা মানছেন, গিরিশ পার্কে ‘ওয়াই-সাইডিং’ (যার মাধ্যমে প্রয়োজনে ট্রেনকে একটি লাইন থেকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়া যায়) থাকায় বিপত্তি আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কাটানো গিয়েছে। না হলে সমস্যাটা আরও গুরুতর হত। ওই পরিকাঠামো এ ছাড়া রয়েছে ময়দান, টালিগঞ্জ এবং দু’টি প্রান্তিক স্টেশন দমদম, কবি সুভাষে। |
বিপত্তির শুরু বিকেল ৩টে ৫৬ মিনিটে। মেট্রো সূত্রের খবর, দমদম থেকে কবি সুভাষগামী একটি ট্রেন গিরিশ পার্ক স্টেশনে এসে আচমকা বিকল হয়ে যায়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চাকা নড়ছিল না সেটির। যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে মেরামতির জন্য ওই রেকটিকে টালিগঞ্জ বা নোয়াপাড়া কারশেডে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। সেইমতো যাত্রীদের নামিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যাটা যে আরও জটিল, তা তখনও বোঝা যায়নি। পরিকল্পনা মতো ট্রেনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘ব্যর্থ’ হন চালকেরা। পরিস্থিতির গুরুত্ব টের পেয়ে দ্রুত গিরিশ পার্ক স্টেশনে পৌঁছে যান মেট্রো রেলের ইঞ্জিনিয়ারেরা। ছিলেন মেট্রোর চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারও (রোলিং স্টক)। কিন্তু, তাঁদের কসরতেও কাজ হচ্ছিল না। শেষে ট্রেনটিকে সরিয়ে নেওয়া হয় ওয়াই-সাইডিংয়ে। ততক্ষণে প্রায় আড়াই ঘণ্টা কেটে গিয়েছে।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, চাকা আটকে ট্রেন বিকল হওয়ার ঘটনা ২৮ বছরে এই প্রথম ঘটল। সংস্থার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (জেনারেল) তথা জনসংযোগ আধিকারিক প্রত্যুষ ঘোষ জানান, ওই ট্রেনটির একটি কোচের চাকা আটকে গিয়েছিল। গিরিশ পার্ক স্টেশনে একটি ‘ওয়াই-সাইডিং’ রয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরের ওই সাইডিং-এ ঘষটে-ঘষটে বিকল রেকটিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে সময় লাগে ঘণ্টা দু’য়েক। ওই সময়ে আপ এবং ডাউনের ১০ জোড়া ট্রেন বাতিল করা হয়। বিকল ওই কোচটি পুরনো ছিল তা মেনে নিলেও, প্রত্যুষবাবুর বক্তব্য, “নতুন-পুরনো রেক বলে নয়, যান্ত্রিক সমস্যা হতেই পারে। একটা ট্রেনের কোডাল-লাইফ (জীবনকাল) শেষ হয়ে যাওয়া মানে এই নয় যে, সেটি ব্যবহারের উপযুক্ত থাকবে না।” তিনি জানান, যাত্রী সুরক্ষার কারণে নিয়মিত ভাবে ট্রেনগুলির যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে প্রয়োজনে সেগুলি বদলে নেওয়া হয়। প্রত্যুষবাবু আরও জানান, কী কারণে এমন ঘটল, তা দেখা হচ্ছে।
আর মেট্রোর এই ‘অচেনা’ বিভ্রাটে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভুগলেন অসংখ্য যাত্রী। বিকেলে অফিস-ফেরত ভিড়ের প্রশ্নের দাপটে মেজাজ ‘না-খুশ’ চাঁদনি চক মেট্রোর প্রবেশপথে মোতায়েন নিরাপত্তাকর্মীর। ‘ট্রেন কখন চলবে, তা জানব কী করে? দমদমে যেতে হলে বাসে যান’ ভিড় হঠাতে একই কথা বারবার বলতে হচ্ছিল তাঁকে। সন্ধ্যায় অফিসপাড়ার মেট্রো স্টেশনগুলির সামনে রাজপথে থিকথিকে ভিড়। বাদুড়ঝোলা বাসেই ফেরার পথ ধরতে বাধ্য হলেন অফিস-ফেরত জনতা। ‘সুযোগ’ পেয়ে যাত্রীর কাছ থেকে চড়া ভাড়া হাঁকলেন অনেক ট্যাক্সিচালক। একই ছবি ছিল উত্তরে দমদম থেকে দক্ষিণের রবীন্দ্র সদন স্টেশন চত্বরের আশপাশেও।
পরিষেবা বন্ধ থাকায় তুমুল ভিড় হয় দমদম, বেলগাছিয়া, শ্যামবাজার, শোভাবাজার স্টেশনে। যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। মেট্রো কর্তৃপক্ষ টোকেনের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা জানান। হই-হট্টগোল বেধে যায় প্ল্যাটফর্ম, টিকিট কাউন্টারের সামনে। শিয়ালদহ শাখার একের এক পর ট্রেন এসে দমদমে থামছে, আর যাত্রীদের ভিড় উপচে পড়ছে সংলগ্ন মেট্রো স্টেশনে। মেট্রো জানায়, গিরিশ পার্কে রেক বিকল হওয়ার পরে প্রথম দিকে ঘণ্টাখানেক কবি সুভাষ থেকে ময়দানের মধ্যে ট্রেন চলছিল। পরে পরিষেবা চালু হয় সেন্ট্রাল পর্যন্ত। কিন্তু সন্ধ্যা গড়ালেও দমদম থেকে সেন্ট্রালের মধ্যে পরিষেবা শুরু হয়নি। ৬টা ২০ মিনিটে যখন পরিষেবা স্বাভাবিক হয়, তখন যাত্রীদের মুখে-মুখে একই কথা, “পুরনো বগিতে তো ফের এই দুর্ভোগ হবে।” |