সামনে ভরা পর্যটন মরসুম। তাই পাহাড়ের আমজনতা চাইছে না, নতুন করে ‘আত্মঘাতী’ আন্দোলনে তপ্ত হোক এলাকা। পাহাড়ের মানুষের এই ‘মানসিকতা’ এবং সেই সঙ্গে রাজ্যের ‘অবস্থান’কেও গুরুত্ব দিয়ে আপাতত যাবতীয় আন্দোলন তুলে রাখল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। শনিবার দুপুরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল এই কথা জানিয়েছে।
তরাই, ডুয়ার্স থেকে বাড়তি মৌজার অন্তর্ভুক্তি এবং জিটিএ নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল, শনিবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে তা আপাতত মিটেছে। বৈঠকের পরে মোর্চা প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে তিনি বলেন, “গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে এ দিনের আলোচনা খুব ভাল হয়েছে।” মোর্চা প্রতিনিধিরাও খুশি। গুরুঙ্গ বলেছেন, “আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে আমরা খুশি। আপাতত আর আন্দোলনের প্রশ্ন নেই।” তিনিই জানান, আলোচনায় সর্বসম্মত ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জিটিএ আইন মেনে জুনের শেষে কিংবা জুলাইয়ের প্রথমার্ধে পাহাড়ের তিন মহকুমায় ভোট হবে। তার আগে জুনের প্রথমার্ধের মধ্যেই শ্যামল সেনের নেতৃত্বাধীন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির রিপোর্ট জমা পড়বে।
যে হেতুু ওই কমিটিতে মোর্চার চার জন প্রতিনিধি রয়েছেন, সে জন্য রিপোর্টে মোর্চার দাবি একেবারে উপেক্ষিত হবে বলে গুরুঙ্গ মনে করেন না। জিটিএ গঠনের সঙ্গে ওই রিপোর্টের সরাসরি কোনও যোগসূত্র নেই। |
তবে তরাই-ডুয়ার্সের কোনও এলাকা জিটিএ-তে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কমিটি সুপারিশ করলে, সেই মতো পদক্ষেপ করবে রাজ্য সরকার। মোর্চা সভাপতির কথায়, “কমিটি তরাই-ডুয়ার্সের কোনও এলাকা জিটিএ-র আওতায় আনার কথা বললে মোর্চার মত সাপেক্ষে কাউকে মনোনীত করে জিটিএ-তে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার।”
তবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির কাছে ইতিমধ্যেই প্রায় ৭০০ আবেদনপত্র পড়েছে। আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, সিপিএম, কংগ্রেস-সহ একাধিক সংগঠন তরাই-ডুয়ার্সের ‘এক ইঞ্চি জমিও জিটিএ-র আওতায় আনা যাবে না’ বলে দাবি করেছে। সে ক্ষেত্রে কমিটি কোনও এলাকা অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ না করলে কী হবে? জবাবে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “ডুয়ার্সের কালচিনি থেকে মোর্চা সমর্থিত নির্দল বিধায়ক উইলসন চম্প্রামারি বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। তা ছাড়াও প্রস্তাবিত ৩৯২টি মৌজায় গোর্খাদের প্রাধান্য রয়েছে। সময়ই সব বলবে। আমরা তো কমিটির সুপারিশ মেনে নিতে দায়বদ্ধ।”
বস্তুত, গোড়া থেকেই তরাই-ডুয়ার্সের ৩৯২টি মৌজা জিটিএ-র আওতায় আনার দাবি সামনে রেখে আন্দোলন করছে মোর্চা। সুবাস ঘিসিংয়ের পরিচালনাধীন দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদের আওতায় ছিল পাহাড়ের তিন মহকুমা। তাই নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির দাবি খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করে রাজ্য সরকার। তা নিয়ে তরাই-ডুয়ার্সে ক্ষোভ দানা বাঁধে। চুক্তি সইয়ের পরে তরাই ও ডুয়ার্সে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সেখানকার বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করেন।
|
শান্তি সূত্র |
• জুলাইয়ের গোড়ার মধ্যে জিটিএ-র ভোট।
|
• ভোট ডিজিএইচসি-র পুরনো এলাকাতেই। |
• জুনের গোড়ায় রিপোর্ট পেশের অনুরোধ উচ্চ পর্যায়ের কমিটিকে। |
• কমিটির সুপারিশ মানবে রাজ্য ও মোর্চা। |
• জিটিএ-তে নতুন এলাকার সুপারিশ হলে মোর্চার মত নিয়ে প্রতিনিধি মনোনয়ন। |
|
সম্প্রতি জিটিএ মেনে পাহাড়ের তিন মহকুমায় ভোটের জন্য রাজ্য সরকার প্রস্তুতি শুরু করলে মোর্চার অন্দরেই প্রশ্ন ওঠে। মোর্চা সূত্রের খবর, তরাই-ডুয়ার্সের মোর্চা নেতাদের একাংশ দার্জিলিঙে গিয়ে বিমল গুরুঙ্গের সামনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেই সময় মোর্চা নেতারা হুমকি দেন, তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত না-হলে ভোটের প্রশ্নই নেই। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে লাগাতার আন্দোলনের কথাও ঘোষণা করেন।
কিন্তু, জিটিএ চুক্তির পরে পাহাড় ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে। তরাই-ডুয়ার্সের চা-বলয়ের পরিস্থিতিও অনেক স্বাভাবিক। এই অবস্থায় মোর্চার হুমকিতে তরাই-ডুয়ার্সে তো বটেই, পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ দানা বাঁধে। আসন্ন গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে পাহাড়ে পর্যটকের ঢল নামার যথেষ্ট সম্ভাবনা। এর মধ্যেই হোটেলগুলিতে প্রচুর বুকিং হয়েছে। এই অবস্থায় পাহাড়ের সাধারণ মানুষ চাইছেন না, নতুন করে আন্দোলনে তপ্ত হোক এলাকা। ভেস্তে যাক তাঁদের ব্যবসার সম্ভাবনা। তাই তাঁরা মোর্চা নেতাদের জানিয়ে দেন, নতুন করে আন্দোলনের নামে কোনও ‘আত্মঘাতী’ অবস্থান তাঁরা নেবেন না। আমজনতার এই ‘মানসিকতা’ বুঝেই আন্দোলনের ব্যাপারে সুর নরম করেন মোর্চার শীর্ষ নেতৃত্ব। এবং ‘মুখরক্ষার উপায়’ খুঁজতে দফায় দফায় বৈঠকে বসেন। সেই সময়েই গুরুঙ্গদের ডেকে পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। মোর্চা সূত্রের খবর, বৈঠকের আগে নানা ভাবে মোর্চা নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন। সেই মতো ‘অবস্থান’ নেওয়া হবে বলে মোর্চা নেতাদের আশ্বস্ত করে রাজ্য সরকার।
এ দিন দুপুরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওই বৈঠক চলে টানা দু’ঘণ্টা। বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে ছিলেন রোশন গিরি, এল বি পেরিয়ার, অনীত থাপা, মধুসূদন থাপা ও গণেশ আলে। রাজ্য সরকারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব ছাড়াও ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম। ওই বৈঠকে পাঁচ দফা সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। তার পরেই মোর্চার তরফে প্রশ্ন তোলা হয়, নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ হলে সেখানকার প্রতিনিধি কী ভাবে জিটিএ-তে যাবেন?বৈঠকে উপস্থিত মুখ্যসচিব সমর ঘোষ জানান, জিটিএ আইন অনুযায়ী ৫ জন সদস্যকে রাজ্যপাল মনোনীত করবেন। যদি নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ হয়, তা হলে আয়তন বুঝে জিটিএ-তে এক বা একাধিক সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তাতে আইনও যেমন বাঁচবে, তেমনই নতুন এলাকাগুলির মানুষেরও জিটিএ-তে প্রতিনিধিত্ব থাকবে। জিটিএ-র পরের ভোটে নতুন করে ৪৫টি আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হবে। এর পরেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন মোর্চা নেতৃত্ব। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা জানান, রাজ্য তাঁদের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ায় গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে আন্দোলনে যেতে হবে না। তিনি জানান, এতে যেমন আমজনতাও বিরূপ হবে না, তেমনই তরাই-ডুয়ার্সের দলের নেতাদের ক্ষোভ প্রশমন করারও উপায় থাকবে।
এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার সাম্প্রতিক নির্বাচনে দার্জিলিঙের কোনও প্রতিনিধিত্ব না-থাকায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেন বিমল গুরুঙ্গ। তাঁর মতে, এটা ‘ভুল’ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন। |