কলকাতা থেকে ফের ডানা গোটাচ্ছে লুফৎহানসা। আজকের উড়ানের পরই বন্ধ হচ্ছে এই জার্মান হাঁসের উড়ান। আর সেই সঙ্গে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যে শিল্পায়নের মলিন ছবিটিকে।
শিল্পমহলের দাবি, কোনও শহরের আর্থিক উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আন্তর্জাতিক উড়ান যোগাযোগের বিষয়টি। সে ক্ষেত্রে গত ক’বছরে কোনও বড় লগ্নি দেখেনি এ রাজ্য। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস সামান্য আশার আলো দেখালেও, নানা জটে রাজারহাটে তাদের প্রকল্পও বন্ধের মুখে। আর শিল্পায়নের এই শ্লথগতিই লুফৎহানসার বিদায়ের কারণ। যেমন, একই ভাবে ব্যবসা হারিয়ে আগেই কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। রাজ্যের পর্যটন শিল্পের আশঙ্কা, এ বার জার্মানির এই বিমান সংস্থার কলকাতা ছাড়ার দায়ও চোকাতে হবে তাদেরই। কারণ এর ফলে মাসে অন্তত ৫ কোটি টাকার ব্যবসা হারাবে তারা। অথচ ১৯৫৯ সালে এশিয়ায় প্রথম লুফৎহানসার উড়ান চালু হয়েছিল কলকাতা থেকেই।
লুফৎহানসা কর্তৃপক্ষের দাবি, বাজার না-থাকায় উড়ান তুলে নিচ্ছেন তাঁরা। তবে ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে ফিরে আসবেন। আজ রবিবারই কলকাতা থেকে তাদের শেষ উড়ান রওনা দিচ্ছে ফ্রাঙ্কফুর্টে। সপ্তাহে তিন দিন ফ্রাঙ্কফুর্ট-কলকাতা রুটে উড়ান চালাত সংস্থা।
শিল্পমহলের একাংশের মত, নতুন রাজ্য সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু শুধু মুখে লগ্নিকে স্বাগত জানানোর কথায় যে সারবত্তা নেই, তা লুফৎহানসার মতো সংস্থার উড়ান বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকেই স্পষ্ট। প্রসঙ্গত, ন্যানো-সহ বিভিন্ন শিল্প প্রকল্পের প্রস্তাব নতুন করে আস্থা জোগানোয় ২০০৬ সালে কলকাতা থেকে ফের উড়ান চালু করেছিল এই সংস্থা। মাঝে উড়ান সংখ্যা বাড়ালেও পরে সপ্তাহে তিন দিনের সূচিতে ফেরে তারা। রাজ্যের ভাবমূর্তির সমস্যার পক্ষে সেটাই ছিল প্রথম সঙ্কেত, মত সংশ্লিষ্ট মহলের। প্রসঙ্গত, এর আগে অস্থির সত্তরের দশকে ১৯৭১ সালে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যার কারণে রাজ্য ছেড়েছিল লুফৎহানসা। |
ইন্দো-জার্মান চেম্বার অফ কমার্সের পূর্বাঞ্চলের প্রাক্তন কর্তা বি জি রায়ের দাবি, আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবায় লাভের উৎস বিজনেস ক্লাস। কারণ প্রতিযোগিতায় টিকতে ইকনমি ক্লাসের দাম কম রাখার ক্ষতি পুষিয়ে দেয় বিজনেস ক্লাস। আর এই ক্লাসের টিকিট বিক্রি শিল্পায়ন বা আর্থিক কর্মকাণ্ডের উপরই নির্ভরশীল। বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের সেক্রেটারি জেনারেল প্রিয়দর্শন রায়েরও মত, “রাজ্যে যথেষ্ট আর্থিক কর্মকাণ্ডের অভাবেরই প্রতিফলন লুফৎহানসার বিদায়। বিজনেস ক্লাসে যাত্রী না হওয়ার অর্থ, বড় বড় সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের যাতায়াত কমছে।”
তবে কলকাতা ভুগলেও লগ্নি টেনেই আরও আন্তর্জাতিক উড়ান পাচ্ছে অন্য শহর। লুফৎহানসার উড়ানসূচিতেই আছে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই থেকে দৈনিক ফ্রাঙ্কফুর্টের উড়ান। পুণের মতো ছোট শহর থেকেও সপ্তাহে ৪ দিন উড়ান চলে। কারণ পুণে এখন বহু জার্মান সংস্থা-সহ লগ্নিকারীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য।
রাজ্যের পর্যটন শিল্পমহলের মতে, কলকাতা থেকে ইউরোপের অন্য শহরের সঙ্গেও পরোক্ষে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল লুফৎহানসাই। দুবাই হয়ে কলকাতা আসার সুযোগ থাকলেও ‘জেট ল্যাগ’ ও সময় বাঁচাতে অধিকাংশ ইউরোপীয় পর্যটকই সরাসরি উড়ানের জন্য লুফৎহানসাকেই বাছতেন। পর্যটন সংস্থা লিভিং রুটসের কর্তা শুদ্ধব্রত দেবের দাবি, দৈনিক এই উড়ানে শুধু পর্যটক ভিসা নিয়েই মাসে গড়ে প্রায় ৫০০ পর্যটক শহরে আসেন। ইম্প্রেশন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের কর্তা দেবজিৎ দত্তর দাবি, ওই পর্যটকেরা ১০-১২ দিনের সময়কালে মাথা পিছু কমপক্ষে এক লক্ষ টাকারও বেশি খরচ করেন। উড়ানটি বন্ধ হলে মাসে অন্তত ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হারাতে হবে। যতটুকু ব্যবসা আসবে, তার লভ্যাংশের হারও কমবে বলে তাঁদের দাবি।
কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১০-এ কলকাতা বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক যাত্রী সংখ্যা বাড়ে ২০%। দেশের অন্যান্য অগ্রণী বিমানবন্দরের হিসেবে যা নজরকাড়া। নয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি চালু হলে ব্যবসার সম্ভাবনা আরও বাড়বে। তখন হয়তো আবার কলকাতায় ফিরবে জার্মান হাঁসের উড়ান। |