প্রাক্তনীদের কাছেও সাহায্য প্রার্থনা
কলকাতার শরণে দুঃস্থ অক্সফোর্ড
ক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অ্যান্ড্রু হ্যামিল্টন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ঈর্ষা করতেই পারেন!
হ্যামিল্টন কলকাতায় এসেছেন অক্সফোর্ডে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের আকর্ষণ করতে। পাশাপাশি অক্সফোর্ডের প্রাক্তনীদের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন জানানোটাও আর একটা লক্ষ্য। কারণ ন’শো বছরের অক্সফোর্ডকে এমন আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়নি আগে কখনও। ব্রিটিশ সরকার অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। বাড়াতে হয়েছে পড়ুয়াদের টিউশন ফি। তাতেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
অ্যান্ড্রু হ্যামিল্টন
দুনিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা এখন এতটাই গভীর যে, খোদ উপাচার্যই অনুদান সংগ্রহে বেরিয়েছেন। ‘দুঃসময়ের’ কথা প্রাক্তনীদের জানাচ্ছেন, অনুরোধ করছেন সাহায্য করার জন্য। তার জন্য তাঁকে উজিয়ে আসতে হচ্ছে এ রাজ্যেও, যেখানে অক্সফোর্ডকে চিরকাল উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বলে শুধু মেনে আসা হয়েছে তা-ই নয়, রাজ্যের সেরা পড়ুয়ারা অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পাওয়াকে অমূল্য সৌভাগ্য বলে মনে করেছেন। অতীত থেকে বর্তমান, রাজ্যের সেরা শিক্ষাবিদরা অনেকেই অক্সফোর্ড-ফেরত। অথচ এই মুহূর্তে এ রাজ্যেরই কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা কিন্তু অক্সফোর্ডের চেয়ে ভাগ্যবান। বিশ্বের অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে স্থান না মিললেও তাঁদের এখনও হেঁসেল সামলানোর জন্য প্রাক্তনীদের কাছে দরবার করতে হয়নি। সে কথা স্বীকারও করেছেন কলকাতার উপাচার্য তথা অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী সুরঞ্জনবাবু।
দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনের তকমা গায়ে সেঁটে থাকার জন্যই হোক বা ঐতিহ্যের প্রতি সম্ভ্রমের কারণেই হোক, শিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে অক্সফোর্ড এখনও গরিমায় উজ্জ্বল। ইন্দিরা গাঁধী থেকে মনমোহন সিংহ ও মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, মনসুর আলি খান পটৌডি থেকে তাঁর কন্যা সোহা অক্সফোর্ডে ভারতীয়দের পড়াশোনার নজির নেহাত কম নয়।
কলকাতা সফরে এসে সে কথাই বারবার মনে করাচ্ছিলেন হ্যামিল্টন। ‘ড্যাফোডিল’, ‘চেরি ব্লসম’-এ ভরা, সবুজ ঘাসে ঢাকা ‘লনে’ সজ্জিত অক্সফোর্ড বছরের এই সময়টাতে কতটা ‘সুন্দরী’ হয়ে উঠেছে, শোনাচ্ছিলেন সেই গল্প। এমনকী ভোলেননি অক্সফোর্ডের ‘পাব’-এর কথা উল্লেখ করতেও।
কিন্তু কেন? শুধু নামের মাহাত্ম্যেই যদি অক্সফোর্ড সমুজ্জ্বল, তা হলে তার উপাচার্যকে রংবেরঙের ফুল, সমান করে ছাঁটা ঘাসের গল্প শোনাতে হচ্ছে কেন? কেনই বা বারবার উল্লেখ করতে হচ্ছে অক্সফোর্ডের ‘টিউটোরিয়াল’ পদ্ধতির কথা? ইমরান খানের কথা ধার করে কেন বলতে হচ্ছে, অক্সফোর্ডের পড়াশোনা আসলে সেখানকার পড়ুয়াদের ‘মনের গঠন’ তৈরি করে?
শনিবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিলেন হ্যামিল্টন। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স, লোরেটো কলেজের স্নাতক-স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সেখানে উপস্থিত ছিলেন অক্সফোর্ডের অনেক কৃতী প্রাক্তনী। সেখানেই সরকারি অনুদান কমে যাওয়ার কথা জানান হ্যামিল্টন। তিনি বলেন, “ব্রিটেনে সরকারি অনুদান ভীষণ ভাবে কমানো হয়েছে। ব্রিটিশ ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি বাড়ানো হয়েছে। একটা কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা।” আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, এমনকী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রাক্তনীরা মোটা টাকা অনুদান দিলেও অক্সফোর্ডে সেই রেওয়াজ প্রায় নেই বলেই এ দিন খেদোক্তি করেন হ্যামিল্টন।
ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে সেখানকার সরকার। মোট দেশীয় উৎপাদনের মাত্র ১.২% বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য ব্যয় হয়। স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য এত দিন এক জন ছাত্রের থেকে বছরে সর্বোচ্চ ৩,৩৭৫ পাউন্ড নেওয়া যেত। সেই অঙ্ক বাড়িয়ে এখন ৯ হাজার পাউন্ড করা হয়েছে। অক্সফোর্ডের একটি সূত্রের খবর, স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য সেখানে ছাত্র পিছু বছরে ১৬ হাজার পাউন্ডেরও বেশি খরচ হয়। ৯ হাজার পাউন্ড টিউশন ফি নেওয়া হলেও আরও ৭ হাজার পাউন্ড জোগাড় করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কর্তৃপক্ষ। ছাত্রছাত্রীরাও এ নিয়ে চিন্তিত। বছরে ৯ হাজার পাউন্ড টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করার যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই তাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে।
শুক্রবার আইআইটি-খড়্গপুরের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েও অনুদান সংগ্রহের উপরে জোর দিয়েছিলেন হ্যামিল্টন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য সব থেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ হল অনুদান সংগ্রহ করা। এই কাজে আমার অনেকটা সময় ব্যয় হয়।” শনিবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে তিনি জানালেন, প্রয়োজনে ভারতীয় শিল্পপতিদের কাছেও অনুদানের জন্য আবেদন করবেন তাঁরা।
ব্রিটেনের ছাত্রছাত্রীরা যে ফি-তে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে পারেন, বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের তার থেকে অনেক বেশি ফি দিতে হয়। তাই হ্যামিল্টন অন্যান্য দেশের পড়ুয়াদের ভর্তি হতে আকৃষ্ট করতে চাইছেন বলে অক্সফোর্ডের প্রাক্তনীদের একাংশের মত। শুক্রবার আইআইটি খড়্গপুরেই হ্যামিল্টন জানিয়েছিলেন, আইএসসি-সিবিএসইর দ্বাদশ শ্রেণিতে ৯০ শতাংশ নম্বর পেলে অক্সফোর্ডে ভর্তির জন্য আবেদন জানানো যাবে। সেখানে তিনি অকপটে বলেন, “ভারত, চিন, দক্ষিণ আমেরিকা-সহ গোটা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে না পারলে ৯০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা যাবে না।”
অক্সফোর্ডের এই অবস্থা দেখে দুঃখিত প্রাক্তনীরা। অক্সফোর্ড থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হয়েছেন, গবেষণা করেছেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী। তিনি বলেন, “খারাপ লাগছে যে অক্সফোর্ডকেও এ ভাবে প্রচার করতে হচ্ছে। তবে এ তো একটা নতুন যুগ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে।” সুরঞ্জনবাবু বলেন, “সারা পৃথিবী জুড়ে, বিশেষত পশ্চিমী দুনিয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে অনুদানে কোপ পড়েছে। অক্সফোর্ডেও তার আঁচ পড়েছে।”
দীর্ঘ ৪০ বছর অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা করেছেন অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী। লন্ডন থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, “গবেষণা থেকে গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা সব খাতেই বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। সরকার বদলের পরে সেই প্রবণতা আরও বেড়েছে। কোথাও শিক্ষক পদ খালি হলে দীর্ঘ দিন সেখানে নিয়োগ হচ্ছে না। কর্মচারীর সংখ্যা কম রাখা হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতনও সে ভাবে বাড়ছে না।” তাঁর মতে, এই দিক থেকে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ এ দেশে শিক্ষা খাতে অনুদান বাড়ানোই হয়, কমে না।
নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.