প্রতিবেশীকে ঈর্ষা করা নাকি স্বভাবগত। দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালও এই মানবিক প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে নহেন! কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ স্ট্রিটের প্রতিবেশী। রাজ্যপাল প্রথম প্রতিষ্ঠানটির আচার্য। রাজ্য সরকার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে সেন্টার ফর এক্সেলেন্স বা উৎকর্ষের কেন্দ্র ঘোষণা করিয়াছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ভাষণে রাজ্যপাল প্রশ্ন করিলেন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় যে মর্যাদা পাইয়াছে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাহা পাইবে না কেন? ‘উৎকর্ষের কেন্দ্র’ একটি আলঙ্কারিক তকমা নহে। কোনও প্রতিষ্ঠান উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত হইতে চাহিলে তাহাকে কিছু শর্ত পূরণ করিতে হয়। যেমন, সেই প্রতিষ্ঠানে প্রকৃতার্থে বিশ্বমানের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে; পাঠ্যক্রম আধুনিক হইবে; কোনও কায়েমি স্বার্থকে প্রশ্রয় না দিয়া শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদেরই নিয়োগ করিতে হইবে; পঠনপাঠনের প্রশ্নে শিক্ষকদের মতই চূড়ান্ত হইবে; শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইবে ইত্যাদি। রাজ্যপাল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, অনুমান করা যাইতে পারে, তিনি সেই প্রতিষ্ঠানটির বাস্তব চিত্র সম্বন্ধে সম্যক রূপে অবহিত। তিনি সম্ভবত নিজেই বুঝিতেছেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে, এই শর্তগুলির কোনওটিই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নহে। ফলে, উৎকর্ষের কেন্দ্র হওয়াও অসম্ভব। ‘উৎকর্ষের কেন্দ্র’ ধারণাটির দুইটি অভিমুখ। প্রথমত, একটি বিশেষ কেন্দ্রকে যথাবিধি পরিচর্যা করিয়া তাহাকে একটি উদাহরণ হিসাবে গড়িয়া তোলা, যাহাতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি তাহা হইতে অনুপ্রাণিত হইতে পারে। দ্বিতীয় কথা, ব্যয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ সীমিত। সেই সীমিত অর্থ বহু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগ করিয়া দিলে প্রত্যেকের ভাগে যতটুকু পড়ে, তাহাতে সমতাবিধান হয় বটে, কাজের কাজ হয় না। ফলে, কোনও একটি বিশেষ কেন্দ্রকে, তাহার উপস্থিত গুণমানের ভিত্তিতে, বাছিয়া লইয়া তাহার উৎকর্ষসাধনের চেষ্টা করিলে সম্পদের কুশলী ব্যবহার হয়। এই দ্বিমুখী যুক্তিতে দেখিলে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উৎকর্ষের কেন্দ্র’ হইয়া উঠিবার দাবি ধোপে টেকে না। রাজ্যে যদি আরও কোনও উৎকর্ষের কেন্দ্র গড়িতেই হয়, তাহা কলিকাতা হইতে দূরে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কলিকাতার ছাত্রছাত্রী, গবেষকদের জন্য তো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থাকিলই। যে জেলাগুলি হইতে কলকাতায় আসা মুশকিল, সেইখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় কেন্দ্রগুলি গড়িলে রাজ্যের লাভ। ‘উৎকর্ষের কেন্দ্র’ হিসাবে স্বীকৃতি না পাইলেই যে উৎকর্ষের চর্চা মুলতুবি রাখিতে হইবে, তাহা নহে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বহু প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। এক সময় সে সর্বজনমান্য ছিল। তাহার পর গঙ্গায় প্রচুর জল বহিয়া গিয়াছে, মহাকরণেও। সেই জলের ধারায় প্রতিষ্ঠানটির গরিমা বহুলাংশে মুছিয়া গিয়াছে। তাহা ফিরাইয়া আনা সম্ভব। এখনও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগ যথেষ্ট দক্ষতার সহিত কাজ করে। সেই বিভাগগুলিকে পৃথক গুরুত্ব দেওয়া হউক। অন্য বিভাগগুলিও যাহাতে সেই মানে পৌঁছাইতে পারে, তাহার জন্য যত্ন করা হউক। এক দলতন্ত্রকে সরাইয়া অন্য দলতন্ত্র যাহাতে শিকড় না গাড়ে, তাহা নিশ্চিত করা হউক। মানসিকতার অচলায়তন ভাঙুক। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতই মুক্তচিন্তার, বিশ্ব-জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হইয়া উঠুক। অন্তরে উৎকর্ষ সাধিত হইলে বাহিরের স্বীকৃতিও মিলিবে। আর, যদি না-ও মেলে, অর্জিত উৎকর্ষ কেহ কাড়িয়া লইতে পারিবে না। |