এ বার উত্তর কলিকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ হাতিবাগান বাজার। আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার ধারাবাহিকতায় কোনও ছেদ নাই। নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট কিংবা অনেক আগে নিউ মার্কেট একে-একে শহরের পুরানো-নূতন ভবনগুলি পুড়িয়া ছাই হইতেছে, ইহা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। যাহা আশ্চর্যের, তাহা হইল, আস্ত জতুগৃহে পরিণত গোটা শহরটাই কী উপায়ে এবং কোন রহস্যে এখনও ছারখার না হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। আগুন লাগার যাবতীয় উপকরণ শহরের বাড়ি ও বাজারগুলিতে যে ভাবে মজুত, বাধ্যতামূলক অগ্নিনির্বাপণ বন্দোবস্ত না করিয়া যে ভাবে বাজারগুলিকে প্রসারিত হইতে দেওয়া হইয়াছে, পুরসভা, পুলিশ ও দমকলের অনুমতি ছাড়াই, এমনকী ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াও যে ভাবে সেই বাজারের কলেবর স্ফীত হইয়াছে, তাহাতে করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া এগুলির বাঁচিয়া থাকার কোনও ব্যাখ্যাও নাই।
শহরের বিভিন্ন বাজার, বহুতল যে আজ বারণাবতে পরিণত হইয়াছে, এবং তাহার পরেও টিকিয়া আছে, তাহার দায় নিঃসন্দেহে সরকার তথা পুর প্রশাসনের। কিন্তু সরকার বা পুরসভা যেহেতু সর্বদাই দলীয় (দলনিরপেক্ষ প্রশাসন নয়), এবং যেহেতু রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াতেই যে এই সব অনিয়ম নিত্য সংঘটিত হয়, তাই কার্যক্ষেত্রে পুরসভা, পুলিশ বা দমকল কর্তৃপক্ষের তাহা নিবারণের সাধ্য থাকে না। তাই শাসকরা নিজেদের প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা অগ্রাহ্য করিয়া সর্বসম্মতি বা রাজনৈতিক ঐকমত্যের আড়ালে আশ্রয় খোঁজেন। ভোটারদের বিরূপ করার শঙ্কায় বৃহত্তর মঙ্গলের শুভবোধ দ্বারা কেহই তাড়িত হয় না। শহর বারণাবত পরিণত হয়। ইহা কি এ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনপ্রণালীরই ওতপ্রোত সীমাবদ্ধতা? গণতন্ত্রের নির্বিকল্প মর্যাদা স্বীকার করিবার পরেও এই প্রশ্নটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। গণতন্ত্র যেহেতু গণের তন্ত্র, তাই সেই গণকে চটাইলে ক্ষমতা থাকে না। কোনও রাজনৈতিক দল তাই বিপজ্জনক বাড়ি বা বাজার ভাঙিয়া সেখানে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, নিরাপদ নিলয়ের নির্মাণের চেষ্টা করে না। তাই নিউ মার্কেট পুড়িয়া যাওয়ার পরও তাহাকে ঢালিয়া সাজার সুযোগ সরকার গ্রহণ করে না। নন্দরাম মার্কেটের সংস্কারের কৃত্য অসম্পূর্ণ পড়িয়া থাকে।
গণতন্ত্র যে বহুজনহিতের কথা বলে, আদর্শ অবস্থায় সমাজের ভিতর হইতেই তাহার প্রেরণা জাগ্রত হইয়া শাসন সংস্কারের পথ সুগম করিবে। কিন্তু ভারতীয় সমাজে গণতন্ত্র এখনও সংখ্যার তোষণ, পরিমাণের পুষ্টি, তাহা আজও সর্বমঙ্গলের গুণগত উৎকর্ষ নয়। শাসক যত ক্ষণ দলীয় রাজনীতিক, দলনিরপেক্ষ প্রশাসক নহেন, তত ক্ষণ এই স্বার্থের খেলাই গণতন্ত্রকে ভিতর হইতে অন্তর্ঘাত করিতে থাকে। এ কথা কেবল বর্তমান শাসক গোষ্ঠী সম্পর্কে নয়, ইহার পূর্বসূরির ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। বস্তুত, ভারতীয় গণতন্ত্রের সীমান্ত এ ভাবেই নির্ধারিত হইয়া আসিতেছে। দল, দলীয় স্বার্থ, অনুগতদের প্রতি অনুগ্রহ বিতরণের তাগিদ, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠিয়া সরকারকে, সরকারি প্রশাসন, সংস্থা, দফতরকে দৃঢ় ভাবে এই অনিয়মের নৈরাজ্য ঘুচাইতে হইবে। প্রতিটি বাজার পরিদর্শন করিয়া তাহার বিপজ্জনক অংশ, প্রয়োজনে সম্পূর্ণটাই ভাঙিয়া ফেলা, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া, উপ-ভাড়াটিয়াদের হদিশ করিয়া নিয়মিত রাজস্ব আদায় ও সেই তহবিলে রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণের সুচারু বন্দোবস্ত করা, জলাধার সহ অগ্নিরোধক যাবতীয় বন্দোবস্ত মোতায়েন করা অত্যাবশ্যক। এ জন্য যদি অনেক দোকান উজাড় হইয়া যায়, স্থানান্তরিত হয় কিছুসংখ্যক বিপণি, হারাইতে হয় বেশ কিছু ভোট, তবে তাহাই সই। সরকারের তো ভোটারের প্রয়োজন নাই, সে-প্রয়োজন দলের। দল হইতে সরকারকে বিচ্ছিন্ন করা হউক। |