|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
ভূতের রাজা ‘খুশ হুয়া’ |
বাংলা ছবিতে ভূতের এমন মর্যাদাপূর্ণ অথচ মিষ্টি উপস্থিতি বিরল।
লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
উপস্থিত ভূতমণ্ডলী এবং সভ্যবৃন্দ,
আমরা আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে সমাগত হয়েছি। আপনারা সকলে অবগত আছেন যে, হালে বঙ্গদেশে একখানি ‘ছায়া’ছবি মুক্তি লাভ করেছে। ছবিটি করার আগে পরিচালক অনীক দত্ত মহাশয় স্পুকবুক(সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট) মারফত আমাদের ‘ভৌতিক সমাচার দর্পণে’র অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, ভূতসমাজ নিয়ে তিনি একটি গবেষণাধর্মী কাহিনিচিত্র বানাতে চান। আমরা তাঁকে যাবতীয় তথ্য-নথি জোগান দিয়ে সহায়তা করি। এ বিষয়ে আমাদের বিদ্বজ্জন চূড়ামণিদেরও (যথা, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, রাজশেখর বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তপন সিংহ প্রমুখ) পূর্ণ অনুমোদন ছিল। সুতরাং ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’কে বলা যেতে পারে পিপিপি মডেল অর্থাৎ কিনা ‘প্রেত-পাবলিক পার্টনারশিপে’ নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রপ্রয়াস।
কিন্তু এই যৌথ উদ্যোগে আমাদের অংশগ্রহণের কারণ কী ছিল? কারণ আর কিছুই নয়। অনীকবাবুর বস্তুনিষ্ঠ, শ্রেণিসচেতন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ভাল লেগেছিল। ভূত ভদ্রমণ্ডলীর সকলেই জানেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সম্পর্কে নানা রকম কুৎসা, কুবাক্য এবং ভ্রান্ত চেতনা মনুষ্যজগতে প্রচলিত আছে। অল্প বিদ্যা সততই ভয়ঙ্করী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো দু’এক জন ছাড়া আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার লোক ইদানীং কমে গিয়েছে। অথচ তথ্যনির্ভর গবেষণা এবং মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিকোণ ছাড়াই বিচিত্র আষাঢ়ে, গাঁজাখুরি কাহিনি ফেঁদে ভূত-চরিত্র হননের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সমান ভাবে বলবৎ রয়েছে। কয়েকশো মানহানির মোকদ্দমা সোপর্দ হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি এর কোনও ফয়সালা হয়নি।
যেমন ধরুন, ভূতের বেগার খাটা! ছিঃ! মূল্যহীন শ্রম বোঝাতে আমাদের নাম ধরা কেন? আর এ কথাই বা কে বলেছে যে, আমরা বেছে বেছে সুখীদের কিল আর ঠিক দুক্কুরে ঢিল মেরে থাকি? নিতান্ত গেরোয় না পড়লে আমরা কক্ষনও কাউকে ভয় দেখাই না। ‘হাড় হিম করা আতঙ্ক’ মানুষেই তৈরি করে, আমরা না। আমাদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই? বাঙাল ভূত বাজার থেকে কানকো টিপে ইলিশ কিনে আনে না বুঝি? আর এটাই বা কে বলল যে, আমরা রাম নাম মুখে আনি না! তাবৎ ‘রাম’ নামধারীরা মরলে পরে তাদের তবে কী বলে ডাকা হয়? গা-জ্বালানি কথা শুনলে করোটিতে রক্ত উঠে যায় বাপু! আমাদের চেহারা নিয়ে গুল-গপপো তো ছেড়েই দিলাম! অনীকবাবু ভূত-চতুর্দশীর ফ্যাশন শো-খানা দেখিয়ে অ্যাদ্দিনে একটা কাজের কাজ করলেন! সেখানে র্যামসে সাহেব (জর্জ বেকার) অনভ্যাসের ধুতি নিয়ে একটু বেসামাল হচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাকিটা? পিকচার পারফেক্ট!
আসলে অনীকবাবুকে তাঁর বারো ভূতের আখ্যানে সাহায্য করে আমরা কিন্তু মনুষ্যদের প্রতি একটা পষ্ট বার্তা দিতেই চাইছিলাম! এবং সেই একই উদ্দেশ্যে এই বক্তৃতার কপিও আমরা মনুষ্যদের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে পাঠাব বলে ঠিক করেছি! শুনহ মানুষ ভাই, আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে, তেলেভাজা চিবিয়ে মস্করা করার বস্তু নই! আমাদেরও ‘লাইফ’ আছে! মোবাইল ফোন আছে, আইটেম নম্বর আছে। ঘটি-বাঙালের ঝগড়া আছে। মামদোবাজ হাতকাটা-কার্তিক আছে। অস্তিত্বের সঙ্কট আছে, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিও আছে। পুরনো বাড়িঘরদোর ভেঙে ভূতশূন্যপুর, মানে শপিং মল-টল বানাবার যে হিড়িক পড়েছে, তাতে আমাদের প্রেতাত্মা ওষ্ঠাগত! |
|
ভূতের ভবিষ্যৎ
পরান, সব্যসাচী, বিশ্বজিৎ, স্বস্তিকা, শাশ্বত,
পরমব্রত,
মীর, জর্জ, খরাজ, সমদর্শী, মুমতাজ, সুমিত |
চৌধুরী প্যালেসের কথাই ধরুন! হরেক কিসিমের ভূতেদের একান্নবর্তী সংসার। ‘ইয়ায়ামরাআ চৌধুরী প্যালেসের ভূত’ বলে নেচেগেয়ে ভালই চলছিল। ভূত-পূর্ব জীবনে এনাদের কেউ ছিলেন সায়েবসুবো, কেউ জমিদার, কেউ নকশাল, কেউ কার্গিল-শহিদ, কেউ বিহারী রিকশাওয়ালা তো কেউ সিরাজি পাচক! কেউ বড়লোকের আদুরে মেয়ে, কেউ বাংলা ব্যান্ডের ব্যর্থ গায়ক! কেউ বা কদলীবালা! কদলীবালাকে চিনতে পারলেন না? আঙুরবালাদের যুগে পিছিয়ে যান না মশাই! কদলী ওখানেই ছিলেন! খোনা গলায় গুচ্ছের চন্দ্রবিন্দু সহযোগে বিরহের গানও গেয়েছেন! তার পর তাঁকে কলা, মানে কদলী দেখিয়ে পালিয়ে গেল তাঁর প্রেমিক! হৃদয়ে চোট পেয়ে কদলীবালা চক্ষু মুদলেন! এখন জনৈক গণেশ ভুতোড়িয়ার দৌলতে যদি এই চৌধুরীবাড়ি ভেঙে ভূত ভাগানো অভিযান শুরু হয়, এনারা করেন কী?
অনীকবাবু এমন একটি আন্তরিক ভূত-সচেতন ছবি উপহার দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা-ভাজন হয়ে রইলেন। সেই সঙ্গে সংলাপে, গানের লাইনে, ক্যামেরার ফ্রেমে বঙ্গজীবনের অনুপুঙ্খ উইটি রেফারেন্স মিশিয়ে দিয়ে ছবিটাকে আপাদমস্তক ‘ব্যাডলি বাঙালি’ (ব্যাজস্তুতি, বলাই বাহুল্য) বানিয়ে ফেললেন! সেখানে গুপিবাঘা-ফেলু-মণিহারা-ক্ষুধিত পাষাণ-শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-ওরা থাকে ওধারে-হযবরল-ঝালাপালা-সুনীলের কবিতা-মুক্তিযুদ্ধ-ইস্টবেঙ্গলমোহনবাগান-বাঙালি খিস্তি-ঋত্বিক-মৃণাল, মায় ‘ম্যাজিক রিয়্যালটি’ পর্যন্ত বিবিধ রতন ছড়িয়ে রইল! দেখতে দেখতে মনুষ্য জন্মের নস্টালজিয়া ফিরে আসছিল বারবার! অভিনেতাদের প্রত্যেককে ভূতদের তরফে সংগ্রামী অভিনন্দন। পরমব্রত আর সব্যসাচীর অংশে ফেলু-তোপসের পুরনো রসায়ন যেন ঝিকিয়ে উঠল আবার (প্রয়াত ‘জটায়ু’ বিভুও তো আছেন!)। জর্জ বেকার, পরান-বিশ্বজিৎ-সমদর্শী-মমতাজ-মনামি খুবই ভাল অভিনয় করেছেন। এঁরা সব আহা ভূত! দুর্দান্ত লেগেছে সুমিত সমাদ্দার আর শাশ্বতকে। বাহা ভূত! না-ভূতের ভূমিকায় মীর, খরাজ? অদ্ভুত!! এবং এবং এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়! কদলী-অবতারে তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স নিয়ে জাস্ট কোনও কথা হবে না! ভূতের রাজার বর তাঁর জন্য থাকুক!
অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা এক-একটা সময়কে বোঝাতে এক-একটা রং এবং টেক্সচার বেছে নিয়েছে। তার সঙ্গে ক্লাসিক বাংলা ছবির অব্যর্থ সব দৃষ্টিকোণ! রাজা নারায়ণ দেবের সঙ্গীত এ ছবির আর এক ‘নায়ক’! তবে অর্ঘ্যকমল মিত্র সম্পাদক হিসেবে আর একটু কিপ্টে হতে পারতেন! অনীকবাবুকেও বলি, ছবির প্রথমাংশটা একটু দীর্ঘায়িত মনে হল! মানে, আমাগো ভূতেদের এন্ট্রি আরেট্টু তাড়াতাড়ি হলে ভাল হত! মাঝে সমদর্শী-মমতাজের অংশটাও একটু সংক্ষিপ্ত হতে পারত!
আরও একখান নালিশ আছে! আপনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ‘ভৌতিক সমাচার দর্পণে’র নাম কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায় থাকবে! এই কথাডার খেলাপ হইল ক্যান? যাউক গিয়া! অন্য দিক থেকে পুষিয়ে দিয়েছেন! সেই কত কাল ধরে আমরা ভূতেরা বাঙালির বনের মোষ তাড়ানো বাই-য়ে আর্থিক অনুদান জুগিয়ে আসছি! এই গানের দল, ওই কবিতার কাগজ, সেই নাটকের শো, তস্য ডকুমেন্টারি! একটা কৃতজ্ঞতা কেউ কোনও দিন জানিয়েছে? আপনি জানালেন! আপনি দীর্ঘজীবী হোন!
কিন্তু বাকি মনুষ্যদের কী হবে? যত্ত সব ভূতের ডিম! ওরে বাবা! ভূতই তো ভবিষ্যৎ! জীবনের একটাই ‘বিধি’বদ্ধ সতর্কীকরণ সবাই ম’লে ভুতো হবে! সেই পরকাল যদি ঝরঝরে করতে না চাও, ভালয় ভালয় এই ‘ছায়া’ছবি দর্শন করতঃ ভূতাধিকার আন্দোলনে ‘সলিডারিটি’ জানিয়ে এসো!
নচেৎ ন ভূতো, ন ভবিষ্যতি! |
|
|
|
|
|