পার্বত্য দার্জিলিঙের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাটি মীমাংসার আশু কোনও সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু কাল ধরিয়া উচ্চস্বরে দাবি করিয়া আসিতেছেন যে, জঙ্গলমহল ও সমতলের পাশাপাশি তিনি ‘পাহাড়ের সমস্যা’ও সমাধান করিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু পার্বত্য দার্জিলিঙের বাস্তব পরিস্থিতি সে কথা বলে না। সত্য, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাবি মতো আগের পার্বত্য পরিষদ ভাঙিয়া দিয়া নূতন একটি ‘গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন’ (জিটিএ) গঠিত হইয়াছে। কিন্তু এই গঠন কেবল খাতায়-কলমে। নির্বাচিত না-হওয়া অবধি এই প্রশাসন তাহার প্রাপ্য রাজনৈতিক এক্তিয়ার বা আর্থিক তহবিল কিছুই পাইবে না। মুখ্যমন্ত্রী তাই অচিরে জিটিএ-তে নির্বাচন চান, কিন্তু মোর্চা নেতৃত্ব তাহাতে অসম্মত। যত ক্ষণ তরাই ও ডুয়ার্সের গোর্খা-অধ্যুষিত এলাকাগুলি জিটিএ-র অন্তর্ভুক্ত না হয়, তত ক্ষণ মোর্চা নির্বাচন হইতে দিবে না। আশু তেমন সম্ভাবনা নাই, যেহেতু ওই এলাকা-নির্ণয়ের দায়িত্ব একটি কমিটির হাতে ন্যস্ত হইয়াছে, যাহা সে-ভাবে এখনও কাজই শুরু করে নাই। ইহারই মধ্যে ২৭ মার্চ-এর মধ্যে সিদ্ধান্ত লওয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা ধার্য করিয়া মোর্চা নেতৃত্ব নব-পর্যায়ে আন্দোলন শুরুর হুমকি দিয়াছেন।
দার্জিলিং সমস্যার সমাধানে সূচনাটি কিন্তু মন্দ ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী হইয়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার পাহাড়ে গিয়াছেন, গোর্খা নেতৃত্বকে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়া তাঁহাদের মন জয় করিয়াছেন, একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করিয়া জনতার শুভেচ্ছাও কুড়াইয়াছেন। কিন্তু গোর্খা আত্মশাসনের মূল প্রশ্নটির মীমাংসা হয় নাই। এ জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, তাহাতে গোর্খাদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বও নাই। এলাকা নির্ধারণের ভার যাঁহাদের উপর, তরাই ও ডুয়ার্সের জনজাতীয় বিন্যাসের কাঠামো সম্পর্কে তাঁহাদের সম্যক ধারণা আছে কি না তাহা স্পষ্ট নয়। সর্বোপরি গোটা বিষয়টি লইয়া ওপর-ওপর তাড়াহুড়া করার একটা প্রবণতা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে লক্ষিত হইয়াছে। সাত মাস কিংবা নয় মাসের মধ্যে ‘পাহাড়-সমস্যা মিটাইয়া দিয়াছি’, এই ঘোষণায় অধৈর্য দ্রুতি প্রকট। যে-সরকার অন্তত পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতাসীন, তাহাকে রাজ্যের ‘নিরানব্বই শতাংশ সমস্যা’ নব্বই দিন কিংবা নয় মাসের মধ্যে মিটাইয়া ফেলিতে হইবে কেন? এই তাড়াহুড়ার মধ্যে সমস্যার গভীরতা ও জটিলতা সম্যক উপলব্ধি করিতে না-পারার সমস্যাও থাকা অসম্ভব নয়। সর্বোপরি, এ ভাবে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর হইতে বার-বার ‘সমাধান করিয়া দিলাম’ উচ্চারিত হইতে থাকিলে যাঁহাদের সমস্যা সমাধান করিয়া দিবার দাবি করা হইতেছে, সেই গোর্খা জনজাতির মানুষের মনে হীনম্মন্যতা জাগ্রত হইতে পারে। জনজাতীয় আত্মশাসনের বিষয়টি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রশ্ন, সাবধানতার সহিত যাহার মোকাবিলা করা উচিত।
মোর্চা নেতৃত্ব আসন্ন রাজ্যসভার নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। ডুয়ার্সে আন্দোলনেরও। ডুয়ার্সের আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতৃত্ব জিটিএ-র প্রশাসনিক এক্তিয়ারে অন্তর্ভুক্ত হইতে সম্মত হইয়াছিলেন। এখন তাঁহারাও মোর্চার কর্মসূচির বিরোধিতা করিতেছেন। বামফ্রন্টের জমানায় পাহাড় ও সমতলবাসীদের মধ্যে, গোর্খা, চা-বাগানের মজুর ও ডুয়ার্সের আদিবাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া সমস্যাকে যে ভাবে জিয়াইয়া রাখা হইত, কতকটা অনুরূপ চিত্রনাট্যও যেন পাশাপাশি উন্মোচিত হইতেছে। লক্ষণগুলি শুভ নয়। সরকারের সূত্র অনুযায়ী না চলিলে গোর্খারা অভীষ্ট স্বশাসন পাইবেন না, এমন বার্তা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ধৈর্য ও সহানুভূতির সহিত আলাপ-আলোচনা ও লেনদেন ভিন্ন এ ক্ষেত্রে সমাধানের পথ নাই। |