নিজের মহাকীর্তি গড়া মাঠে দাঁড়িয়ে সচিন তেন্ডুলকর দেখলেন ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন তারকার জন্ম হয়ে গিয়েছে। বিরাট কোহলি।
কয়েক দিন আগেই হোবার্টে বিস্ময়কর ১৩৩ করে এসেছেন। কিন্তু যত দিন ভারত-পাক ক্রিকেটের মহাযুদ্ধ থাকবে, তত দিনের জন্য কোহলির নাম একেবারে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেল। যে ইনিংস তিনি রবিবার মীরপুরের মাঠে খেলে গেলেন, তা কোনও ভারতীয়ের খেলা সর্বকালের সেরা ওয়ান ডে ইনিংসের তালিকায় ঢুকে পড়তে বাধ্য। বরং তর্ক উঠে যেতে পারে এটাই সর্বসেরা কি না। তিরাশির বিশ্বকাপে টানব্রিজ ওয়েলসে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের ১৭৫ নট আউট-কে আজও ধরা হয় ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ওয়ান ডে ইনিংস। কোহলির আজকের ইনিংসের পরেও কি তর্কাতীত ভাবে সেটা আর বলা যাবে? জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট হয়ে যাওয়া ভারতকে টেনে তোলা কপিলের অবিশ্বাস্য ১৭৫ নট আউট? নাকি এ দিন ৩২৯ তাড়া করতে নেমে ২.১ ওভার বাকি থাকতে ছয় উইকেটে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে চূর্ণ করা বিরাট কোহলির ১৪৮ বলে ১৮৩? কোনটা আগে থাকবে?
আরও কত সব ওয়ান ডে মণিমুক্তো নিয়েও তো টানা-হ্যাঁচড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ভিভ রিচার্ডসের ১৮৯-ও যার মধ্যে এসে পড়ছে। সচিন তেন্ডুলকরের প্রথম ওয়ান ডে ডাবল সেঞ্চুরি। সেটা ভেঙে সহবাগের নতুন রেকর্ড তৈরি করা ইনিংস। শারজায় তেন্ডুলকরের খেলা পরপর দু’টো মহাকাব্যিক ইনিংস। ঢাকাতেই সৌরভের একটা দুর্দান্ত ম্যাচ জেতানো ইনিংস ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সব নতুন করে যেন এসে পড়ছে বিচারকের টেবিলে।
শেষ পর্যন্ত কোহলির আজকের ১৮৩ সেরার সেরা স্বীকৃতি পাবে কি না, সেটা হয়তো তর্কের ব্যাপার। কিন্তু যেটা নিয়ে কোনও তর্কের অবকাশ নেই তা হচ্ছে, মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার তফাতে ভারতীয় ক্রিকেটের খুব উজ্জ্বল দু’টো দিন মঞ্চস্থ হয়ে থাকল মীরপুরের মাঠে। ১৬ মার্চ যখন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর শততম সেঞ্চুরির বিরল মুকুট জয় করলেন। আর ১৮ মার্চ যখন বিরাট কোহলি নামক দিল্লির তরুণের উদ্দাম রথে চড়ে ৩২৯ তাড়া করেও পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল ভারত। কোহলি আউট হয়ে ফিরছেন... দেখা গেল পাক টিমের অনেক ক্রিকেটার এসে পর্যন্ত পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেলেন। সচরাচর ভারত-পাক ম্যাচে যা দেখাই যায় না। |
ভারত-পাক ক্রিকেট-যুদ্ধ মানে এক দিকে যেমন মাঠের বাইরে রং আর তীব্র আবেগের খেলা, তেমন মাঠের মধ্যে চূড়ান্ত হাড্ডাহাড্ডি আর রক্তাক্ত যুদ্ধের ছবি। এ দিন যেমন ভিআইপি গ্যালারিতে উপস্থিত অক্ষয়কুমার এবং বলিউডের আরও কিছু মুখ। গ্যালারিতে অদ্ভুত রকমের ভারসাম্য। ভারতের নামে জয়ধ্বনি আছে, তেমন ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, পাকিস্তান জিতেগা’ স্লোগানও চলল। মুখে তেরঙ্গার ছবি আঁকা দর্শক যেমন ছিল, তেমনই ছিল পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাও। তেন্ডুলকর ব্যাট করতে নামার সময় যেমন গ্যালারি তাঁর নামে জয়ধ্বনিতে গর্জন করে উঠল, তেমনই চিৎকার শোনা গেল শাহিদ আফ্রিদি নামার সময়। আর কোহলি তাঁর মহাকাব্যিক ইনিংসে ভারত-পাক বরাবরের এই যুদ্ধের ছবিটাকে সরিয়ে দিয়ে টাঙিয়ে দিলেন সম্ভ্রমের ছবি। যে সব শট তিনি এ দিন খেলেছেন, তার সঙ্গে একমাত্র তুলনা হতে পারে বোধহয় শারজার সচিনের। উমর গুলকে হেলায় বোলারের মাথার ওপর দিয়ে তুলে দিলেন। তার পরের বলেই কভারের ওপর দিয়ে চরম ঔদ্ধত্য নিয়ে ছয়।
আর কী পরিস্থিতিতে এই ইনিংস? না, একে পাকিস্তান ম্যাচ। বব উলমারের মৃত্যুদিনে অন্য রকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখানো পাকিস্তান। যারা প্রথম বল থেকে হাবেভাবে বুঝিয়ে দিল, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের প্রতিশোধ তুলতে এসেছে। তার উপর ধোনিদের মরণবাঁচন ম্যাচ। এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলতে হলে পাকিস্তানকে হারাতেই হবে। না হলে নানা রকম সব জটিল অঙ্কের ফাঁসে আটকে পড়ার ঝক্কি থাকছে। সেই মহা লড়াইয়ে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান তুলে ফেলল ৩২৯-৬। তাদের দুই ওপেনার এমন খেলছিলেন যে, দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরাই ম্যাচ শেষ করে দিয়ে গেলেন। মহম্মদ হাফিজ এবং নাসির জামশিদের জোড়া সেঞ্চুরির পর অনেকেই দেখলাম এশিয়া কাপে ধোনির টিমের শোকগাথা লিখে ফেলেছে।
তার উপর আবার তেন্ডুলকর বল করতে গিয়ে আঙুলে চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। ব্যাট করতে পারবেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না। বিশ্বকাপ ফাইনালের পর এই প্রথম বল হাতে দেখা গেল সচিনকে। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারেই বিপত্তি। হাফিজের জোরাল ড্রাইভ ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙুল ফেটে গেল। ১৯৮৯-এর নভেম্বরে অভিষেক টেস্টে রক্তাক্ত সেই ঝাঁকড়া চুলের বিস্ময় বালকের স্মৃতি ফিরে এল অনেকের। সে দিন ওয়াকার ইউনিসের বলে নাক ফেটে যাওয়ার পরেও মাঠ ছেড়ে যাননি তিনি। এ দিন আম্পায়ারের কাছ থেকে এক বার বলটা চেয়ে নিয়ে গ্রিপ করে দেখলেন ঠিক মতো ধরতে পারছেন কি না। পারছেন না দেখে বেরিয়ে গেলেন। ভারত-পাক ম্যাচে সচিন আচমকা চোট পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মানে একটা দিক পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। রুগী কোমায় চলে গেল। কিন্তু পাকিস্তান ম্যাচ যে! সচিন ব্যাট হাতে ফিরলেন এবং তেন্ডুলকরীয় ভঙ্গিতে ৩২৯ তাড়া করার রিংটোনটা তিনিই সেট করে দিলেন। কখনও চামচের মতো থার্ডম্যান দিয়ে ছয়। কখনও চকিতে ব্যাকফুটে কভার ড্রাইভ। হালফিলের সেরা ওয়ান ডে ইনিংসটা তিনি উমর গুলদের জন্যই তুলে রাখলেন। দু’দিন আগে শততম সেঞ্চুরি করে উঠে যে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকটা পাকিস্তান ম্যাচ আমাকে আরও ভাল প্লেয়ার করে দেয়’, প্রত্যেকটা শট থেকে সেই বক্তব্য ঠিকরে বেরোচ্ছিল। সচিনের ৪৮ বলে ৫২ না থাকলে পাল্টা প্রত্যাঘাতের গাড়িটা হয়তো আজ স্টার্টই দিত না। শুরুর দিকে নড়বড়ে থাকা কোহলিকে তখন সচিন আড়াল করছেন। পরে কোহলি ছাপিয়ে গেলেন সবাইকে।
এটুকু বললে, পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। ধোনির টিমকে আসলে খেলতে হচ্ছিল পাকিস্তানের চেয়েও কঠিন প্রতিপক্ষকে! ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় উপর্যুপরি বিপর্যয়ে আক্রান্ত ভারতীয় ক্রিকেটকে রক্ষা করার লড়াই লড়তে হচ্ছিল তাঁদের। এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কাছে হেরে এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিলে কী ঘটত আন্দাজ করতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ভারতের নতুন সহ-অধিনায়ক শুধু তাঁর দলকে এশিয়া কাপে টিঁকিয়ে রাখলেন না, ভারতীয় ক্রিকেটকেও বাঁচালেন ফের আক্রান্ত হওয়া থেকে। এর পরই শুরু হচ্ছে আইপিএল। অবধারিত ভাবে বলাবলি শুরু হত, সচিন-পরবর্তী যুগে পড়ে থাকবে শুধু এক টি-টোয়েন্টি প্রজন্ম। যারা শুধু নিলামের চৌকাঠে নির্লজ্জের মতো বিক্রি হতে পারে। সামান্য ক্রিকেটীয় যোগ্যতা নিয়েও কোটিপতি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দেশের গর্ব, সুনাম নিয়ে ভাবে না। যেন মেরুকরণই হয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটে। টি-টোয়েন্টির দামী ক্রিকেটার মানে তার পঞ্চাশ ওভারের ওয়ান ডে-র প্রতি মোহ নেই। চড়াই-উতরাইতে ভর্তি টেস্ট ক্রিকেটের পৃথিবীতে জমি কেনার ইচ্ছে নেই। কোহলি দেখিয়ে গেলেন, আইপিএলের সফল ক্রিকেটার হয়েও তেরঙ্গাকে উপরে তুলে ধরা যায়। পঞ্চাশ ওভারে ক্রিকেটে গর্বের জয় ছিনিয়ে নেওয়া যায়। স্বপ্নের রাত উপহার দেওয়া যায় দেশবাসীকে।
একটা ইতিহাস সৃষ্টি করা বিকেল। আর একটা ইতিহাস সৃষ্টি করা রাত। ভারতীয় ক্রিকেটের ওপর প্রবল ঘুর্ণিঝড় চলার মধ্যে ঘটল মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার তফাতে। যত দিন ভারত-পাক ক্রিকেট থাকবে, যত দিন ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকবে, কোহলির আজকের ১৮৩ থাকবে। আর যত দিন ভারতীয় ক্রিকেট থাকবে তত দিন বোধহয় মীরপুরও থেকে যাবে অন্ধকারে পথ হাতড়াতে থাকা বিশ্বকাপজয়ীদের আলোর রেখা দেখানোর জন্য!
|
স্কোর |
পাকিস্তান |
হাফিজ এলবিডব্লিউ দিন্দা ১০৫
জামশিদ ক ইরফান বো অশ্বিন ১১২
উমর ক গম্ভীর বো প্রবীণ ২৮
ইউনিস ক রায়না বো প্রবীণ ৫২
আফ্রিদি ক কোহলি বো ইরফান ৯
হামিদ ক কোহলি বো দিন্দা ৪
মিসবা নঃআঃ ৪
গুল নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ১৫
মোট ৫০ ওভারে ৩২৯-৬।
পতন: ২২৪, ২২৫, ২৭৩, ৩১৩, ৩২৩, ৩২৬।
বোলিং: প্রবীণ ১০-০-৭৭-২, ইরফান ১০-০-৬৯-১, দিন্দা ৮-০-৪৭-২, রায়না ২.২-০-১৫-০,
রোহিত ৩-০-১৯-০, ইউসুফ ৫-০-৩০-০, অশ্বিন ১০-০-৫৬-১, সচিন ১.৪-০-১২-০। |
ভারত |
গম্ভীর এলবিডব্লিউ হাফিজ ০
সচিন ক ইউনিস বো আজমল ৫২
কোহলি ক হাফিজ বো গুল ১৮৩
রোহিত ক আফ্রিদি বো গুল ৬৮
রায়না নঃআঃ ১২
ধোনি নঃআঃ ৪
অতিরিক্ত ১১
মোট ৪৭.৫ ওভারে ৩৩০-৪।
পতন: ০, ১৩৩, ৩০৫, ৩১৮।
বোলিং: হাফিজ ৯-০-৪২-১, গুল ৮.৫-০-৬৫-২, চিমা ৮-০-৬০-০,
আজমল ৯-০-৪৯-১, আফ্রিদি ৯-০-৫৮-০, রিয়াজ ৪-০-৫০-০। |
|
|