এ বারের গ্রীষ্মকালীন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের বই বাজারে মোটামুটি দু’জনের মধ্যে লড়াই। গ্রেগ চ্যাপেল বনাম ব্রেট লি। ব্রেট লি সদ্য গতকাল মেলবোর্নের শপিং মল-এ বসে নিজের বই উদ্বোধন করেছেন। বড়দিনের বই বাজারে ঢেলে বিক্রির পশরা সাজানো তাঁর গাট্টাগোট্টা আত্মজীবনীর। কিন্তু শুক্রবার মেলবোর্নের বড় বইয়ের দোকানগুলোয় ঘুরে দেখলাম তাঁর চেয়ে চাহিদা বেশি চ্যাপেলের আত্মজীবনীর। নাম ‘ফিয়ার্স ফোকাস’।
আত্মজীবনীর ৩৭১ পাতার মধ্যে ভারত মাত্র ৪২ পাতা। যার মধ্যে সেই অধ্যায় ‘সৌরভ অ্যান্ড মি’। আট ভাগের এক ভাগ। অথচ মনে করা হচ্ছে এই অংশটাই বাণিজ্যিক দিক থেকে সবচেয়ে লোভনীয়। শুধু ক্রিকেটপ্রেমী অস্ট্রেলীয় নয়, এ দেশে বসবাসকারী বিশাল ভারতীয় জনসংখ্যার একাংশও ভারতজনিত বিতর্কের জন্যই চ্যাপেলের বইটা কিনছে।
এ দিন মেলবোর্নে শুনছিলাম বিতর্কের মাত্রা আরও অনেক বেশি হতে পারত। কিন্তু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বেশি উত্তেজক হতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁর আত্মজীবনীর ম্যানুস্ক্রিপ্টের ওপর সেন্সরশিপ জারি করে। বেশ কিছু অংশ চ্যাপেলের ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, এত উত্তেজক কথাবার্তা বার হলে ভারতীয় বোর্ড প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। বলবে, তোমাদের মাইনে করা লোক আমাদের বিরুদ্ধে, আমার প্লেয়ারের বিরুদ্ধে এত সমালোচনামূলক লেখার সাহস কী করে পায়?
চ্যাপেল আপাতত অস্ট্রেলিয়া বোর্ডের ন্যাশনাল ট্যালেন্ট ম্যানেজার। অনূর্ধ্ব সতেরো থেকে শুরু করে টেস্ট টিম পর্যন্ত দেশে ট্যালেন্ট সরবরাহের সাঁকো সামলাচ্ছেন তিনি। ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী চ্যাপেলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। চ্যাপেল-ঘনিষ্ঠদের খবর অনুযায়ী তাঁকে বলা হয়েছিল, নির্বাচক থাকতে চান? না ন্যাশনাল ট্যালেন্ট ম্যানেজার হতে চান? চ্যাপেল দ্বিতীয়টা বেছে নেন। যেহেতু তাতে দশগুণ বেশি মাইনে।
চ্যাপেল এখন সিডনি ছেড়ে মেলবোর্নের বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু এমসিজি-তে এক-আধ দিন খুব সময়ের জন্য ছাড়া শুনলাম মাঠে আসার কোনও পরিকল্পনা নেই। সেটাও যদি আসেন, বিনু মাঁকড়ের পুত্র রাহুলের আমন্ত্রণে খানিকক্ষণের জন্য আসতে পারেন। এ দিন এমসিজি-তে দু’দেশের মিডিয়া ব্যাকুল ভাবে তাঁকে খুঁজছিল। সকলের ধারণা ছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-র আমন্ত্রণে আজই মাইকেল ক্লার্কের টিমকে অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দেবেন গ্রেগ। আর টিপস দেবেন সচিন-সহবাগদের দুর্বলতা কোথায়।
কিন্তু গ্রেগের দেখা সারা দিন পাওয়া যায়নি। মাইক হাসিকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, “আমি জানি না কবে ওর সঙ্গে বসা হবে।” অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট যেহেতু টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কোচ মিকি আর্থার চেয়েছিলেন, হাতে যা যা সম্পদ আছে, বোলিংয়ে লিলি, ট্যাকটিক্সে গ্রেগ চ্যাপেলসব ক’টাকে সাধ্য মতো কাজে লাগানো হোক। তাঁর এই প্রস্তাবে সায় দেন অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক।
গ্রেগ চ্যাপেল নিজে যে দারুণ উৎসাহী ছিলেন, এমন নয়। বরঞ্চ আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন যে ভাবে খবরটা বার হয়েছে যে, তিনি ভারতবধের টোটকা দেবেন। আর তার পর সৌরভ যে ভাবে আইডিয়াটাকে আক্রমণ করেছেন। ইয়ান চ্যাপেল অবধি স্থানীয় কাগজে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছেন, ‘যারা একশোর ওপর টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। যারা দশ হাজারের ওপর রান করেছে। ভারতকে এত বার খেলেছে, তাদের টিপস দিতে হবে বাইরে থেকে? তা হলে নিশ্চয় টিমে বড় কোনও গণ্ডগোল রয়েছে।’
এ সব শুনেই কি চ্যাপেল পিছিয়ে গেলেন? সম্পূর্ণ সংশয়। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-র এক মুখপাত্র বললেন, “মিটিংটা দেখা যাক, আজ-কালের মধ্যে করানো যায় কি না।” ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বইয়ের ওপর যতই সেন্সরশিপ চালাক, এখন অবধি নৈতিক ভাবে চ্যাপেলের সঙ্গে আছে। এদের এবং আইসিসি-র প্রাক্তন কর্তা ম্যালকম স্পিড বলছেন, “আমি বাহান্নটা রিভিউ মিটিং করেছি অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট নিয়ে। একটা বৈঠকেও কেউ গ্রেগ সম্পর্কে আপত্তি তোলেনি। নির্বাচকদের উপস্থিতি প্লেয়াররা ড্রেসিংরুমে পছন্দ করেনি, এটা খুব ঠিক কথা। কিন্তু গ্রেগ একা তো আর ওখানে জোর করে বসতে যায়নি! ওঁদের আলাদা কোনও বসার জায়গাই করা হয়নি। যেটা বোর্ডের তরফে ভুল হয়েছিল।”
কিন্তু বোর্ড যে অংশগুলোর ‘কোট’ বাদ দিল তাতে কী ছিল? এখানে কেউ কেউ বলছেন, সচিন ও ভারতীয় বোর্ড সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু। যা বার হলে বিতর্কের সুনামি হত। আবার কারও কারও মতে অধ্যায়গুলো ছিল সৌরভ ও ভারতীয় বোর্ড সম্পর্কে প্রভূত অত্যাশ্চর্য সংযোজন।
এমনিতে সচিনকে বইতে সে ভাবে আক্রমণই করেননি চ্যাপেল। মহাতারকা, আরও আদর্শ টিমম্যান হলে ভাল হতএই হল সচিন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞান। তিনি জানেন, ব্যক্তিগত গোপন মনোভাব যা-ই হোক, এ মুহূর্তে সচিনকে আক্রমণ করাটা ক্রিকেট বিশ্বে হারাকিরি।
তিন জনকে খোলা শংসাপত্র দিচ্ছেন তিনি। কুম্বলে, দ্রাবিড় ও ধোনি। চ্যাপেল বইতে লিখেছেন, ‘কুম্বলে-দ্রাবিড়ের হাতে পাঁচ বছর আগে দল পরিচালনার দায়িত্ব এলে ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারাই অ্যাদ্দিনে বদলে যেত।’ বই থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দু’জন সম্পর্কে নিজস্ব অতীত আচরণের ব্যাপারে তিনি অনুতপ্ত নন। সৌরভ ও হরভজন!
কিন্তু সৌরভের তীব্র প্রতিক্রিয়াতেই কি তিনি উত্তেজিত হয়ে পন্টিংদের সঙ্গে বসা বানচাল করলেন? না কি কাল আসবেন? জানা গেল না, যেহেতু চ্যাপেল ফোন তুললেন না। শুনলাম, তাঁর ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনিদের নিয়ে বড়দিনের উৎসবে মত্ত।
এটুকু অবশ্য জানা গেল, দায়িত্বে থাকুন বা না থাকুন, গ্রেগ চ্যাপেল সব সময় খবর। আর বিশেষ করে আশেপাশে যদি কোনও গৌরবর্ণ বাঁ হাতির ছায়া থাকে! |