|
|
|
|
‘ডাইন’ সন্দেহে খুন |
হাঁসুয়ার কোপে প্রৌঢ়ের মুণ্ডচ্ছেদ, আত্মসমর্পণ করলেন মেয়ে-জামাই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মালদহ |
জানগুরুর ‘বিধান’ মেনে ‘ডাইন’ ভেবে হাঁসুয়ার কোপে এক আদিবাসী প্রৌঢ়ের মুণ্ডচ্ছেদ করার অভিযোগ উঠল তাঁরই মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের স্ত্রী। ‘বিধান’ মেনেই মঙ্গলবার রাতে মালদহ থানার অর্জুনটোলা গ্রামের ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে জরে মুর্মু (৫০) নামে ওই প্রৌঢ়ের মুণ্ডু ফেলে দেওয়া হয়। শরীরে রক্ত লাগা অবস্থায় থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নিহতের মেয়ে শ্রীমতি এবং জামাই লক্ষ্মীরাম টুডু।
বুধবার সকালে পুলিশ কাটা মুণ্ডুটি উদ্ধার করে। জেলার পুলিশ সুপার জয়ন্ত পাল বলেন, “নিহত প্রৌঢ়ের স্ত্রী রেমডি হাঁসদার অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়ে, জামাই-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” পুলিশ জানিয়েছে, খুনে জড়িত অভিযোগে ধরা পড়া তৃতীয় ব্যক্তির নাম বিশ্বনাথ হেমব্রম। তিনি লক্ষ্মীরামের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, জরে মুর্মু ছিলেন দিনমজুর। তাঁর দুই বিয়ে। দু’পক্ষের সব ছেলেমেয়েই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী রেমডি হাঁসদাকে নিয়ে জরে থাকতেন অর্জুনটোলায়। দম্পতির মেয়ে বছর পঁয়ত্রিশের শ্রীমতির বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম মহিষবাথানিতে। গত বছর দু’য়েক শ্রীমতি নানা রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু ‘ঠিকঠাক’ চিকিৎসা করাননি। পুলিশ সূত্রের দাবি, জেরায় লক্ষ্মীরাম তাদের জানিয়েছেন, স্ত্রী-র রোগ না সারায় সম্প্রতি তিনি হবিবপুরে এক জানগুরুর দ্বারস্থ হন। সেই জানগুরু ‘বিধান’ দিয়েছিলেন, পরিবারের মধ্যে ‘ডাইন-ডাইনি’ ঢুকেছে। ‘ডাইন’ মারতে না পারলে তাঁর স্ত্রী-র অসুখ সারবে না। ওই জানগুরু শ্রীমতির বাবা জরে মুর্মুকে ‘ডাইন’ এবং মা রেমডি হাঁসদাকে ‘ডাইনি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুলিশের কাছে একই কথা বলেছেন শ্রীমতিও।
পড়শিরা পুলিশকে জানিয়েছেন, দিন সাতেক আগে স্বামীকে নিয়ে অর্জুনটোলায় বাপের বাড়িতে আসেন শ্রীমতি। জরে-রেমডির সঙ্গে তাঁদের মেয়ে-জামাইয়ের নিয়মিত ঝগড়া হতে শোনা যেত। রেমডি হাঁসদার দাবি, “মেয়ে-জামাই কয়েকদিন থেকেই বলছিল, ‘তোমরা ডাইন-ডাইনি’। তা নিয়েই কথা কাটাকাটি হত। মঙ্গলবার রাত ৯টা নাগাদ ওরা আমার স্বামীকে ঘর থেকে টেনে বার করে।
আমি ছুটে যাই স্বামীকে বাঁচাতে। কিন্তু ওরা চোখের সামনেই হাঁসুয়া দিয়ে স্বামীর ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিল। তার পর মুণ্ডুটা নিয়ে চলে গেল।”
মালদহ থানার আইসি বিনোদ সিংহ জানান, রাত ১১টা নাগাদ মালদহ থানায় গিয়ে ঘটনার কথা জানিয়ে আত্মসমর্পণ করেন শ্রীমতি-লক্ষ্মীরাম।
হঠাৎ আত্মসমর্পণ করলেন কেন ওই দম্পতি? জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “ওঁরা যে ভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় থানায় এসে খুনের কথা বলছিলেন, তাতে পুলিশকর্মী-অফিসারেরাও প্রথমে চমকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই স্বামী-স্ত্রী আমাদের বলেন, ‘যা করেছি, জানগুরুর নির্দেশে করেছি। লুকিয়ে করিনি। এই ব্যাপারটাই বা লুকোতে যাব কেন’? জরে মুর্মুর দেহ উদ্ধার করার পরে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়।” পুলিশ জানিয়েছে, লক্ষ্মীরামের থেকে পাওয়া সূত্র ধরে হাবিবপুরের সেই জানগুরুর সন্ধানও করা হচ্ছে।
রেমডি হাঁসদার আক্ষেপ, “মেয়ে-জামাই যে আমার স্বামীকে খুন করবে, বুঝতে পারিনি। বুঝলে, ওদের বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দিতাম না।” ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’-এর জেলা সভাপতি ওঙ্কার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ডাইন সন্দেহে এই জাতীয় খুন-জখম রুখতে জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আমরা লাগাতার প্রচার চালাচ্ছি। তার পরেও এ ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। অর্জুনটোলা এবং লাগোয়া গ্রামগুলোতে গিয়ে নতুন করে জোরদার প্রচার চালাব।” |
|
|
|
|
|