সরকারে আসার সাড়ে ছ’মাস পরে রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য ১০% মহার্ঘভাতা (ডিএ) ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার তিনি জানিয়েছেন, ২০১২-র ১ জানুয়ারি থেকে কর্মীরা বকেয়া ভাতা পাবেন। এত দিন যে ভাবে দেওয়া হত, সেই পদ্ধতিতেই সরকারি, আধা সরকারি, সরকারপোষিত সংস্থা, শিক্ষক, পেনশনভোগী-সহ রাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষ কর্মী ওই মহার্ঘভাতা পাবেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
নতুন সরকারের ঘোষণাকে তৃণমূলের কর্মী সংগঠনগুলো ‘স্বাগত’ জানালেও কিছু বাম ইউনিয়ন বকেয়া ২৩% মহার্ঘভাতার দাবি পূরণ না-হওয়ায় আন্দোলন ও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। মহার্ঘভাতার স্থায়ী নির্দেশনামা প্রকাশের দাবি তুলেছে বামপন্থী এবং কংগ্রেস প্রভাবিত
একাধিক সংগঠন।
আগাম বার্তা ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রীর এই আচমকা ঘোষণায় এ দিন মহাকরণে শোরগোল পড়ে যায়। শুরুটাও ছিল নাটকীয়। অফিস বসার পরে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে বিভিন্ন কর্মী সংগঠনকে ফোনে জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করবেন। সেই মতো সাড়ে ১২টায় অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কনফারেন্স রুমে এসেই মহার্ঘভাতার ঘোষণা করেন মমতা। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে তিনি জানান, এই আর্থিক সঙ্কটকালে ডিএ দেওয়ায় অর্থমন্ত্রীর মত ছিল না। কিন্তু অনেকটা ভাতা বাকি পড়ে থাকায় তিনিই বলেছেন কিছুটা দিয়ে দিতে।
পরে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সরকার আর্থিক টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু সুদ দিতেই ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগে। বাজারে দেনা ২৩০০ কোটি। তা-ও সরকারি কর্মীদের সমস্যার কথা ভেবে কিছুটা মহার্ঘভাতা দেওয়া হচ্ছে।” মমতার কথায়, “প্রায় দশ লক্ষ কর্মীকে ১০% ডিএ দিতেই বছরে তিন হাজার কোটি, অর্থাৎ মাসে আড়াইশো কোটি টাকা খরচ হবে।” আবার কর্মী সংগঠনগুলোর একাংশের মতে, জানুয়ারিতে কেন্দ্র আরও ৯% ডিএ ঘোষণা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে এখন ১০% মেটালেও বকেয়া থাকবে আরও ২২%। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আর্থিক অবস্থা ভাল হলে বাদবাকির কথা চিন্তা করবে সরকার।
এ দিকে চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের মহার্ঘভাতা দিতে ৭৫০ কোটি টাকা দরকার। রাজ্যের বেহাল আর্থিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পুজোর আগে সরকার জানিয়েছিল, মহার্ঘভাতা দেওয়া যাবে না। আর্থিক পরিস্থিতির তো তেমন উন্নতি হয়নি! তা হলে বাড়তি এত টাকা আসবে কোথা থেকে?
অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা, “সুদ-বেতন-পেনশন মিলিয়ে প্রতি মাসে বহু টাকা খরচ হচ্ছে। এই সরকার নির্দিষ্ট সময়েই তা পূরণ করছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী যখন ঘোষণা করেছেন, তখন নিশ্চয় মহার্ঘভাতার জন্য অতিরিক্ত অর্থেরও সংস্থান করা হবে। কী ভাবে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” কিন্তু কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রীই তো জানিয়েছিলেন, ১ টাকার মধ্যে ৯৪ পয়সা চলে যায় কর্মীদের বেতন, পেনশন ও ঋণ শোধ (অপরিকল্পিত খরচ) করতে! উন্নয়নের জন্য পড়ে থাকে মাত্র ৬ পয়সা। তা হলে কী মহার্ঘভাতা দিতে গিয়ে উন্নয়নের টাকায় হাত দিতে হবে?
এর কোনও উত্তর এ দিন সরকারের তরফে মেলেনি। রাজ্য শেষ মহার্ঘভাতা দিয়েছিল ২০১০-এর ডিসেম্বরে, ৮% হারে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন্দ্র ২০১০-এর জুলাইয়ে ১০%, ২০১১-র জানুয়ারিতে ৬% ও জুলাইয়ে ৭% ডিএ দিয়েছে। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ও পরবর্তীকালে নতুন সরকার দিতে পারেনি। সব মিলিয়ে বকেয়া তাই ২৩ শতাংশে ঠেকেছে। মমতার কথায়, “অনেকে প্রচার করছেন রাজ্যের হাতে টাকা আছে, তা-ও ডিএ দেওয়া হচ্ছে না। ওঁদের জানা উচিত, ওটা অনুন্নত এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা। ওই টাকায় কর্মীদের বেতন বা ভাতা দেওয়া যায় না।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমার কর্মচারীরা খুব ভাল। ওঁরা কিছু বলেননি। ব্যতিব্যস্তও করেননি। ২০১০ থেকে বকেয়া রয়েছে। তাঁদেরও পরিবার-পরিজন আছে। বাজারে সব জিনিসের দাম আগুন। জানি, কর্মীদের কষ্ট হচ্ছে। নতুন বছরটা ওঁদের ভাল কাটুক। ওঁদের মুখের দিকে তাকিয়েই ডিএ দেওয়া হল।”
কিন্তু বৈঠক ডেকেও মুখ্যমন্ত্রী কথা বলার সুযোগ না-দেওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বামপন্থী কর্মচারী সংগঠনগুলি। সিপিএম সমর্থিত রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যেপাধ্যায়ের দাবি, “এই অর্থবর্ষেই বেতন-পেনশন-ঋণ-বকেয়া ডিএ ইত্যাদি খাতে নন-প্ল্যান বাজেটে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ধরা আছে। সরকার চাইলে বকেয়া সব ডিএ দিতে পারে।” ওয়েস্টবেঙ্গল গভনর্র্মেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নব পর্যায়)-এর নেতা সমীরঞ্জন মজুমদার বলেন, “আপাতত কর্মীরা স্বস্তি পেলেও এ ভাবে বকেয়া ফেলে রাখাটা স্থায়ী সমধান নয়। আমরা আন্দোলনে নামব।” আইএনটিইউসি সমর্থিত কনফেডারেশন অফ ন্যাশন্যালিস্ট স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজের তরফেও স্থায়ী আদেশনামা দাবি করা হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব অবশ্য বলেন, “আমরা রাজ্যবাসীর স্বার্থের পক্ষে। তাঁদের মুখে হাসি ফুটলেই আমরা খুশি। তবে জানুয়ারি আসতে এখনও দেরি। সরকার আগে দিক।” |