পূর্ব কলকাতা জলাভূমি কি শুকিয়ে যাবে?
পূর্ব কলকাতার পাঁচ হাজার হেক্টরেরও বেশি জলাভূমিতে কলকাতা পুরসভার নোংরা জলের জোগান যে ভাবে কমছে তাতে এই প্রশ্নটাই উঠে এসেছে। কলকাতা পুরসভার বর্জ্যবাহী নিকাশি খালগুলি সংস্কারের অভাবে এতটাই মজে গিয়েছে যে এগুলি থেকে পূর্ব কলকাতার ভেড়িগুলির যতটা নোংরা জল পাওয়ার কথা, তার অর্ধেকও পাচ্ছে না। বানতলায় নিকাশি খালে পলি জমায় লকগেট দিয়ে ভেড়িতে জল ঢুকছে অর্ধেকেরও কম। অন্য লকগেটটিরও একই দশা।
কেবল নিকাশি খালেই নয়, পলি জমছে ভেড়িতেও। কিন্তু কোনওটারই সংস্কার না হওয়ায় দ্রুত কমছে ভেড়ির গভীরতা। এই জলাভূমি এলাকার সার্বিক সংস্কার হয়েছিল ২০০২ সালের আগে। ওই বছরে এই জলাভূমি রামসার তালিকাভুক্ত হয়। সম্প্রতি রাজ্য মৎস্য দফতর, কলকাতা পুরসভা এবং পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ‘রামসার’ তালিকাভুক্ত রাজ্যের এই একমাত্র জলাভূমিটির বিপন্নতা কাটানোর উপায় খুঁজতে বৈঠকে করেন। বৈঠকে আমন্ত্রিত সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট (সেফ)-এর কর্ণধার দীপায়ন দে জলাভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, “কলকাতার যে বর্জ্য জল পূর্ব কলকাতার ভেড়িতে ঢোকে, তা বছরে ৭ লক্ষ ৩১ হাজার ৫০০ ঘনমিটার নোংরা বা পলি এনে ভেড়িতে জমা করে। ফলে ভেড়ির গড় গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ সেন্টিমিটার। এ ভাবে চললে ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পূর্ব কলকাতার সমস্ত জলাভূমি ভরাট হয়ে শুকিয়ে যাবে।”
অন্য দিকে, ভুল পরিকল্পনায় খাল সংস্কারের ফলে সেই জলও ভেড়িতে পৌঁছচ্ছে না বলে সেফ-এর তরফে জানানো হয়েছে। কয়েক মাস আগে ওই খালগুলির সংস্কার করেন পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। খালের পলি তুলে দেড় থেকে দু’মিটার গভীর করে কাটায় সেগুলি ভেড়ির তুলনায় বেশি গভীর হয়ে যায়। তাই খালের জল ঢুকছে না। আবার গভীরতা কমায় ভেড়ির জল দ্রুত গরম হয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণও কমছে। ফলে মাঝে মধ্যেই ভেড়িতে মাছ মরে ভেসে উঠছে। ভেড়ির পলি তুলে জলের গভীরতা না বাড়ালে এই সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। কিন্তু পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হাতে ভেড়ি সংস্কারের টাকা নেই।
পূর্ব কলকাতার ভেড়ি ও খাল সংস্কারের জন্য এডিবি-র আর্থিক সাহায্যে কয়েকটি খাল সংস্কার হয়েছে। বহু কাজ বাকি। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের চিফ টেকনিক্যাল অফিসার অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, খালের জল ভেড়িতে ঢোকানোর বিষয়টি সেচ দফতর দেখছে। তবে সমস্যা এখন কিছুটা কম। তিনিও মনে করেন, পলি সরিয়ে খালের সার্বিক সংস্কার ছাড়া এই জলাভূমির বিপন্নতা কাটবে না। তাঁর কথায়, “নিকাশি খাল সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সঙ্গে কথা বলছি। খালপাড়ের জবরদখল তুলতে না পারলে কিছুই করা যাবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে জলাভূমির উন্নয়ন করার চেষ্টা করছি।”
পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ও সেখানকার মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কর্মরত দীপায়নবাবুর বক্তব্য, সরকারি পর্যায়ের কোনও আলোচনাতেই এই জলাভূমি তার পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব পায় না। অথচ পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা সব সময়েই মনে করান, সাড়ে বারো হাজার হেক্টর এই এলাকায় আছে ২৫৪টি ভেড়ি। সেগুলি কলকাতার নিকাশি নোংরা জলে টেনে তা প্রাকৃতিক উপায়ে শোধন করে সেখানে মাছ চাষ করে। নোংরা জল ব্যবহার করে মাছ চাষের দিক থেকে জলাভূমিটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই শহরের বাস্তুতন্ত্রকেও ধারণ করে রেখেছে এটি।
কলকাতার পরিবেশ বাঁচাতে কোনও মূল্যেই ওই জলাভূমি নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ দফতরের মুখ্য উপদেষ্টা তথা নদী ও জলাভূমি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। কিন্তু সরকারি দফতর ও সংস্থাগুলি জলাভূমির পরিবেশগত গুরুত্বের দিকে নজর দেন না বলে অভিযোগ দীপায়নবাবুর। তিনি মনে করেন, জলাভূমি সংরক্ষণে এলাকাবাসী ও মৎস্যজীবীদের যুক্ত না করলে এ কাজ সম্পূর্ণ করা যাবে না। |