সাধন দাসের চিঠি ‘মিড-ডে মিল: তত্ত্ব ও বাস্তব’ পড়লে (২৩-১১) মনে হয়, মিড-ডে মিল একটা ক্ষতিকারক প্রকল্প। অবিলম্বে একে তুলে না দিলে এ রাজ্যের শিক্ষা শেষ হয়ে যাবে। এই বক্তব্য বহু বার আলোচিত। এর অসারতাও নানা ভাবে প্রমাণিত। দরিদ্রতম পরিবারগুলির যে শিশুরা স্কুলের বাইরে থেকে যেত, মিড-ডে মিল যে তাদের প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে জুড়তে পেরেছে, তা এখন সকলেই মেনে নিচ্ছেন। |
মিড-ডে মিল খাওয়ানোর পর ছাত্রদের পড়াশোনার মানে উন্নতি এসেছে, এ-ও দেখা গিয়েছে অন্যান্য রাজ্যে। তবে তত্ত্ব বা পরিসংখ্যানে না গিয়ে কেবল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা চলে, বহু স্কুল আছে যেখানে ভাল ভাবে মিড ডে মিল খাওয়ানো হচ্ছে, পড়াশোনাও ভাল হচ্ছে। মিড-ডে মিল বন্ধ করে দিলে পড়াশোনার মান উন্নত হয়ে যাবে, এ কথা ধরে নেওয়া যায় কী করে? আর সহপাঠীদের পরিবেশন করে খাওয়ানো, সকলের সঙ্গে একসঙ্গে বসে একই খাবার খাওয়া, এগুলোও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ‘সময় নষ্ট’ নয়।
সুকুমার বিশ্বাস। সিউড়ি
|
সাধন দাস এই সত্য আবিষ্কার করেছেন যে, বিদ্যালয় নামক ‘দৈনিক ভোজবাড়ি’তে খাবারের ‘লোভ’ দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধরে আনা হচ্ছে। খেতে না-পাওয়া এই শিশুটিকে শুধুমাত্র পেটের ভাতের জন্য শিশুশ্রমিক হয়ে উঠতে হয়। ইটভাটায় বা বাবুর বাড়িতে তাকে খাবারের ‘লোভ’ দেখানো বাবুদের কেতাবে অপরাধ তো নিশ্চয়ই। তিনি একটি উপায় বাতলেছেন: প্যাকেটবন্দি পুষ্টিকর শুকনো খাদ্য দেওয়া। অবশ্যই বহুজাতিকের দুনিয়ায় প্যাকেটবন্দি কোনও কিছুর ‘লোভ’ রান্না করা খাবারের তুলনায় বেশি হয়। আর সে ক্ষেত্রে কোম্পানিওয়ালাদের সরাসরি ডেকে আনার সুযোগও আছে। তারা দায়িত্ব নেবে দেশের অগণিত অসুস্থ শিশুর জন্য পুষ্টিকর প্যাকেটবন্দি খাবার সরবরাহের। যে রকম পুষ্টিকর খাবার ইতিমধ্যেই তারা প্যাকেটজাত করে বাবুদের বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে এবং তাদের ‘পুষ্টি’ অর্থাৎ স্থূলতা বাড়ছে। প্রশ্ন রইল একটাই, শুনেছি রান্না করা খাবার দেওয়ার অন্যতম প্রবক্তা অমর্ত্য সেন এ-হেন প্যাকেটবন্দি খাবারের প্রস্তাব শুনে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিলেন, তা হলে মেয়েদের আর খাবার জুটল না। অভিজ্ঞতা বলে, যখন খাবারের পরিবর্তে মাথাপিছু চাল দেওয়া হত, তা চলে আসত খোলা বাজারে। সমাজে কন্যাসন্তানের নির্মাণটি এমনই যে, মেয়েদের ভাগ্যে যে প্যাকেটগুলি পড়বে সেগুলি সে ঘরে নিয়ে যাবে এবং অন্যদের মধ্যে সেটা ভাগ হবে। মেয়েরা থাকবে না-খেয়ে। সেই ১৯৪১ সালে ইংল্যান্ডে গ্রেড স্কুলে ছাত্রদের রান্না করা খাবার নিয়ে সমীক্ষা হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই রান্না করা খাবার কত উন্নত করা যায় তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে নানান চিন্তাভাবনা চলেছে। পরিকাঠামোর অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এই সমস্যাগুলি কোনও না কোনও মাত্রায় সব জায়গাতেই ছিল। কিন্তু সেই অজুহাতে কোথাও রান্না করা খাবার তুলে দেওয়ার কোনও যুক্তি কেউ খুঁজে পাননি। কিন্তু এ রাজ্যে ৮৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা যেখানে অপুষ্ট, সেখানে রান্না করা খাবারের বিকল্প খোঁজাটা বাতুল বিলাসিতা। সমস্যা থাকা সত্ত্বেও রাজ্যে যে প্রকল্পটি চলছে তার একটা বড় কারণ, এর প্রয়োজনীয়তা। খণ্ডিত অভিজ্ঞতা থেকে নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটিকে দেখা দরকার।
মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রাহ্মণখণ্ড বাসাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, নানুর, বীরভূম
|
সাধনবাবু তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ ভারতের শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যাহ্নকালীন আহার মিড-ডে মিলের সাদা-কালো দিকের পর্যালোচনা করেছেন। বলা ভাল, একটু বেশি করে নেতিবাচক দিককেই আলোকিত করেছেন। আসলে সব কর্মকাণ্ডেরই ভাল-খারাপ দিক থাকে। নিবন্ধে ব্যবহৃত একটি তথ্যের সংশোধন করি প্রথমেই। বর্তমানে ছাত্রপিছু মিড-ডে মিলে বরাদ্দের পরিমাণ প্রাথমিকে ৩.১৭ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে (পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি) ছাত্রপিছু ৪.০৩ টাকা। বলা বাহুল্য, প্রতিটি বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রসংখ্যার ৮৫ শতাংশ ছাত্রের টাকা বরাদ্দকৃত থাকে মিড-ডে মিলের জন্য। [Order no141/1 of DM dated 02-09-2011 of DM (G)]। কারণ, কোনও বিদ্যালয়েই ১০০ শতাংশ উপস্থিতি থাকে না। মিড-ডে মিলের প্রথম দিন থেকে দীর্ঘ সাত বছর এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে নানান অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখেছি, কলকাতার উপকণ্ঠে, শহরতলিতেও এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা অভুক্ত অবস্থায় বিদ্যালয়ে আসে। গ্রামাঞ্চলে বাবা-মা মাঠের কাজে চলে যায় ভোরবেলায়। ফলে, বাড়িতে হাঁড়িই চড়ে না। সেই ছেলেমেয়েরা শুকনো মুখে এক পেট খিদে নিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহারের প্রতীক্ষায় থাকে। অনেক ছেলেমেয়েই ভাতের টানে বিদ্যালয়ে আসে। এ কথা সত্যি প্রমাণিত হয় প্রতি শনিবার, যে দিন বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল বন্ধ থাকে। আর ছাত্র উপস্থিতিও কমে যায়। কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির চিত্র এই হলে অনুন্নত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে মিড-ডে মিলের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। একপেট খিদে নিয়ে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের মতো বিমূর্ত বিষয় মাথায় রাখা স্বাভাবিক নয়। মিড-ডে মিল-পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা মিড-ডে মিল-পরবর্তী সময়ে হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বেড়েছে। সারা দেশে সাক্ষরতার হার ক্রমবর্ধমান। উল্টো দিকে বিদ্যালয়ছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে। পড়ার টানে না-হলেও খাবারের টানে তারা বিদ্যালয়ে আসছে। সব শিক্ষক না-হলেও বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকার আন্তরিকতার স্পর্শে তারা শিখছেও কিছু। গ্রীষ্মাবকাশ বা পূজাবকাশের দীর্ঘ ছুটির পর অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, “কবে স্কুল খুলবে মাস্টারমশাই?” অর্থাৎ দরিদ্রতম পরিবারের ছেলেমেয়েটির এক বেলার নিশ্চিন্ত ভারী খাবারের সংস্থান, সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাটুকুর ব্যবস্থা, তাঁদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল।
প্রাথমিকে মধ্যাহ্নকালীন রান্না করা খাবারের প্রচলন শুধু মাত্র ভারতেই নয়, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ-সহ বহু দেশে প্রচলিত আছে। ২০০৪ সালে এ রাজ্যে মিড-ডে মিল শুরু হওয়ার দিন ছাত্রপিছু বরাদ্দ ছিল ১ টাকা। আজ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেমন সরকারি বরাদ্দের বৃদ্ধি ঘটেছে, তেমনই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে অভ্যস্থও হয়ে উঠছেন। এমন অনেক বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে টিফিনের ঘণ্টা বাজলে ছাত্রছাত্রীরা শৃঙ্খলার সঙ্গে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ায়। অপেক্ষাকৃত বড় ছাত্ররা বিদ্যালয়ে কেনা স্টিলের থালা (এ পর্যন্ত তিন-চার বার কুকিং ইউটেনসিলের টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রতিটি বিদ্যালয়ে। যা থেকে অনেক বিদ্যালয়ই ছাত্রছাত্রীদের খাবার থালা কিনে রেখেছে) প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর হাতে তুলে দেয়। সঙ্গে লিকুইড সাবানের কয়েক ফোঁটা হাতে ফেলে দেয় হাত ধোওয়ার জন্য। তার পর হাত ও থালা ধুয়ে ছাত্রছাত্রীরা খেতে বসে। খাওয়া শেষ হলে ফের একই ভাবে হাত ও থালা ধুয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় তা জমা রাখে পরের দিনের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির গড় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা যেখানে একশোর নীচে, সেখানে টিফিনের বরাদ্দকৃত সময়ের মধ্যেই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের তদারকিতে রাঁধুনিরা যত্নের সঙ্গে খাবার পরিবেশন করেন। সরকার নির্দেশিত বিশেষ কোনও খাদ্যতালিকা না-থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ নানাবিধ সবজি, ডাল, সোয়াবিন, পোস্ত, ডিম দিয়ে সাপ্তাহিক খাদ্যতালিকা তৈরি করেন। কখনওসখনও মাছ-মাংসেরও ব্যবস্থা হয়।
সমস্যা অন্যত্র। মিড-ডে মিলের সরকারি বরাদ্দের অনিয়মিত জোগান বিপাকে ফেলে শিক্ষকদের। মিড-ডে মিল বন্ধ রাখা অনৈতিক। উপরন্তু মুদিখানা, সবজি, কয়লার দোকানে ধার বাড়তে থাকে ক্রমশ। সব সময়ই চার থেকে ছয় মাসের অর্থ বকেয়া থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ নিজ দায়িত্বে মিড-ডে মিল চালান। দোকানদার ধার দিতে অসম্মত হলে নিজের টাকায় ছাত্রছাত্রীদের দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত করেন শিক্ষকরা।
দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে মিড-ডে মিলের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে মিড-ডে মিল বিকল্পহীন।
সাম্য বাঁক। শালুকগোড়, রামনাথপুর, হুগলি |