সিন্ডিকেট-দায় সিপিএমেরই কি, প্রশ্ন তুলছে পুরনো নথি
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, দলে থাকলে প্রোমোটারি-ঠিকাদারি করা যাবে না। তাঁর নির্দেশের সূত্র ধরেই তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন, প্রাক্তন শাসক দলের ‘পাপের বোঝা’ বর্তমান শাসক দলের ঘাড়ে চেপেছে! এবং সিপিএম নেতৃত্বও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তৃণমূলের এই বক্তব্য একেবারে ‘ভিত্তিহীন’ নয়।
প্রোমোটার-ঠিকাদারদের জন্য দলের দরজা বন্ধ করতে চেয়ে ১১ বছর আগে ‘নোট’ দিয়েছিলেন সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। এখন তৃণমূলের মধ্যে সিন্ডিকেট-বিতর্কের প্রেক্ষিতে সিপিএমের একাংশও ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, সেই ‘নোট’ পুরোপুরি কার্যকর করতে দল ‘সক্রিয় ভাবে উদ্যোগী’ হলে সিন্ডিকেট-চক্র এ ভাবে রাজনৈতিক শিবিরে ছড়ি ঘোরাতে পারত না। শাসক থাকার সময় যা করা যায়নি, তা-ই আবার করতে এ বারের সম্মেলন-পর্বের রূপরেখায় নতুন করে নির্দেশ জারি করতে হয়েছে বর্তমান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে। বলতে হয়েছে, প্রোমোটার-ঠিকাদারদের কমিটিতে রাখা যাবে না। তবে ১১ বছর আগে দলের অন্দরে যে প্রস্তাব এবং ‘নোট’ কার্যকর করতে পারেনি, এখন তা কতটা করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সিপিএমেই।
মমতার এখনকার ভাষাতেই প্রয়াত অনিলবাবু ২০০০ সালের ১৪ মার্চ দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটিকে ‘নোট’ পাঠিয়ে বলেছিলেন, দলের সদস্যেরা প্রোমোটারি-ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। ই এম বাইপাসের সংলগ্ন এলাকায় তখন প্রোমোটার-রাজের প্রভাব বাড়ছিল। ফলে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমে তার আঁচ লেগেছিল। জেলা সম্পাদকমণ্ডলী ওই বছরেরই ১ ফেব্রুয়ারি যে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে রাজ্য কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ‘প্রোমোটারি করলে দলের সভ্য হওয়া যাবে না, এ রূপ সিদ্ধান্ত’ জেলা নিজেই আগে কার্যকর করতে চায়। তার জবাবেই অনিলবাবুর ওই ‘নোট’।
কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, সুজন চক্রবর্তী, ঋষি হালদারেরা তখন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে সেই প্রস্তাবের ‘সমর্থক’ ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে সেই প্রস্তাব যে বাস্তবে দৃঢ় ভাবে আদপেই কার্যকর হয়নি, বিমানবাবুদের বর্তমান নির্দেশিকাই তার প্রমাণ। আলিমুদ্দিনের ‘সক্রিয়তা’র অভাব দেখে এক সময় রাশ আলগা করেছিল জেলা কমিটিও। কালক্রমে শাসক বদলাতে সিন্ডিকেট এখন তৃণমূলের আশ্রয়ে।
প্রোমোটার-ঠিকাদারের সিন্ডিকেটের দাপট যে বন্ধ করা যায়নি, অস্বীকার করছেন না অধুনা সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। তবে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “সমস্যাটা স্বীকার করেই আমরা তার মোকাবিলার চেষ্টা করেছি। সিপিএমের মতো সংগঠন-নির্ভর দল বলে খানিকটা হলেও সমস্যাটা ঠেকানো গিয়েছে। ১০ বছর ধরে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কলকাতার আশেপাশে বেশ কিছু এলাকায় নির্বাচনে আমাদের তার মাসুল দিতে হয়েছে। দলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। অ-বামপন্থী দলে যেটা হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা।” সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, প্রোমোটার-ঠিকাদারেরা বহু জায়গায় দলের ছত্রছায়ায় থেকেছে। দলের অনেকে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু তারা দলের নেতা হয়ে ওঠেনি। আর্থ-সামাজিক ভাবে ওই অংশের ‘ক্রমবর্ধমান প্রভাব’ মোকাবিলায় নিরন্তর লড়াই চালাতে হয়েছে সিপিএমকে। বস্তুত, মাঝেমধ্যেই ‘পার্টি চিঠি’-তেও বিষয়টি নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে।
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ওই সদস্যের কথায়, “বেকারি বেড়েছে। সকলের জীবিকার ব্যবস্থা হয়নি। ফলে নির্মাণ শিল্পের রমরমার সঙ্গে সঙ্গে প্রোমোটার-ঠিকাদারদের প্রতিপত্তি বাড়তে বাধ্য। প্রথমে এরা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আসে। তার পরে দলটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়! এমনকী, লোকাল, জোনাল বা জেলা কমিটির সম্পাদক হতেও! সেটা কিন্তু হতে দেওয়া হয়নি!” তবে দলে এদের প্রবেশ যে একেবারে বন্ধ করা যায়নি, তার প্রমাণ রয়েছে এ বারের দলীয় সম্মেলনেই। কলকাতা শহরেই অন্তত তিনটি লোকাল কমিটিতে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন ঠিকাদারের কাজ করেন, এমন সদস্য!
প্রবীণ সিপিএম নেতা-কর্মীদের একাংশের মতে, দলে সিন্ডিকেট-রাজ গোড়ায় রুখে দেওয়ার পথে বাধা হয়েছিল আলিমুদ্দিনের ‘শিথিল’ মনোভাবই। অনিলবাবুর ‘নোটে’ই বলা হয়েছিল, দলীয় সদস্যদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের উপর ওই সিদ্ধান্ত ‘কার্যকর’ না-করাই ভাল। অথচ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্ব চেয়েছিলেন, কোনও বাছবিচার না-রেখে দলে প্রোমোটারি-ঠিকাদারি বন্ধ করা হোক। কারণ, দলীয় সদস্যদের নিকট আত্মীয়দেরও সিপিএমের (তৎকালীন শাসক দল) ‘নাম’ ব্যবহার করে ‘অসাধু’ কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। আর্থিক দুর্নীতি এবং অপরাধপ্রবণতা বন্ধ করতেই প্রোমোটারি-রাজের পায়ে সামগ্রিক ভাবেই বেড়ি পরাতে চেয়েছিলেন জেলা নেতৃত্ব। সিপিএমের একাংশের বক্তব্য, তখন আলিমুদ্দিন আত্মীয়দের ‘আলাদা’ করতে চাওয়ায় সার্বিক ভাবে তা কার্যকর হয়নি। আর সামগ্রিক নীতি না-থাকায় দলীয় নেতৃত্ব নিজেদের ‘সুবিধা’মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেমন, স্ত্রীর নামে বেনামি জমির কারবার করার অভিযোগে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য স্বপন রায় শাস্তির মুখে পড়েছেন। আর স্বামী অরুণ মহেশ্বরী জমি কেলেঙ্কারি বা আর্থিক বেনিয়ম করলে স্ত্রী কেন দোষী হবেন, এই যুক্তি দেখিয়ে ছাড় পেয়ে গিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার সরলা মহেশ্বরী।
প্রোমোটারি রুখতে ১১ বছর আগের উদ্যোগের সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম সম্পাদক এবং অধুনা পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ডের কথায়, “১৯৯৪ সালে বিধানসভায় শিল্পনীতি পাশ হওয়ার পর রায়চক থেকে কলকাতার সীমানায় বাইপাসের ধারে বেশ কিছু পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নগরায়ন শুরু হতেই প্রোমোটারি-ঠিকাদারি বড় উপার্জনের রাস্তা হিসাবে সামনে আসে। দলের সদস্য তো বটেই, নিকটাত্মীয়দের ক্ষেত্রেও সেটা আটকাতে চেয়েছিলাম। রাজ্য নেতৃত্ব নিষেধাজ্ঞাটি আত্মীয়দের উপরে প্রয়োগ না-করার কথা বললেও জেলা কমিটি কিন্তু নিচু তলায় ব্যাখ্যা করার সময় আত্মীয়দেরও তার আওতায় রেখেছিল। ব্যবসা করলে পার্টি ছেড়ে দিতে হবে আর পার্টি করলে ব্যবসা এটাই মেনে চলার কথা ছিল।”
একই কথা বলছেন এখন মমতা। সিপিএম শেষ পর্যন্ত মেনে চলতে পারেনি। দেখার, মমতা তাঁর দলকে ‘মানাতে’ পারেন কি না।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.